মহারাষ্ট্রে ভারতীয় জনতা পার্টি আর শিবসেনার জোটই ক্ষমতায় থাকল। কিন্তু সন্দেহ নেই, এই বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্য রাজনীতির গ্র্যান্ড ওল্ড ম্যান শরদ পওয়ারই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীসের একটা অতিমানবীয় ভাবমূর্তি ক্রমে গড়ে উঠেছিল রাজ্যে। পওয়ার একার হাতে সেই ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করেছেন। এবং প্রমাণ করে দিয়েছেন, রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তাকে রীতিমতো প্রশ্নের মুখে ফেলা সম্ভব।
গেরুয়া জোট নিজেদের জন্য কঠিন লক্ষ্য স্থির করেছিল: ২৮৮ আসনের বিধানসভায় জিততে হবে ২২০টি। সেই লক্ষ্য থেকে তারা বহু দূরে। ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল ১২২টি আসন। এই দফায় সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে ১০৫টি নিয়েই। শিবসেনাও ২০১৪ সালের ৬৩ থেকে এ বার ৫৬-তে ঠেকেছে।
২০১৪ সালে মহারাষ্ট্রে বিধানসভা নির্বাচনে চতুর্মুখী লড়াইয়ে ১২২টি আসন পেয়ে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। নিজেরা সরকার গঠন করার পর তারা শিবসেনার সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী জোট গড়েছিল। চরম নরেন্দ্র মোদী-ঢেউ থাকা সত্ত্বেও শিবসেনা নিজেদের দখলে ৬৩টি আসন রাখতে পেরেছিল। এ বার কিন্তু জোট হয়েছিল ভোটের আগেই। কয়েক মাস আগের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জয়, এবং কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা লোপের ‘সাফল্য’— দুইয়ে মিলে বিজেপি বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল যে তারা নিজেরাই অন্তত ১৪৫টি আসনে জিতবে। শিবসেনাও চেষ্টা করছিল ১০০টি আসনে জিততে। পাশাপাশি, দুই বিরোধী দল কংগ্রেস ও ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টিতে সমানেই দলত্যাগের ধস নামছিল। ফলে, গৈরিক শিবিরের আশা ছিল, প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করতে পারবে।
কিন্তু পোড়খাওয়া মরাঠা নেতা শরদ পওয়ার হাল ছাড়েননি। তিনি রাজ্যের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত চষে বেড়িয়েছেন প্রায় আশি বছর বয়সের অশক্ত শরীর নিয়েও। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে চেয়েছেন। কৃষকদের আত্মহত্যা, গ্রামাঞ্চলের সঙ্কট, সেই সঙ্কট সামলানোর ক্ষেত্রে সরকারের প্রবল ব্যর্থতা, বন্যা-বিপর্যস্ত এলাকার বেহাল অবস্থা এবং অতি অবশ্যই কর্মসংস্থান— এই প্রসঙ্গগুলিকে ক্রমাগত নিয়ে এসেছেন নিজের রাজনৈতিক বয়ানে। তিনি বিলক্ষণ জানতেন, শহরাঞ্চলে গৈরিক জোটের দখল পোক্ত। তাই তাঁর প্রচারের প্রাণকেন্দ্রে ছিল গ্রামীণ মহারাষ্ট্র, বিশেষত উত্তর মহারাষ্ট্রের আখ উৎপাদনকারী অঞ্চল ও মরাঠাওয়াড়া। নির্বাচনী প্রচারে বেরিয়ে মরাঠা কুলপতি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে রীতিমতো সাড়া পাচ্ছেন, গৈরিক শিবির সেটা খেয়াল করেছিল। কিন্তু তারা পওয়ারকে বিশেষ গুরুত্ব না দিতেই মনস্থ করে। দেবেন্দ্র ফডণবীস বললেন, শরদ পওয়ার এখনও অতীতের রাজনীতি নিয়েই বাঁচছেন।
এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট (ইডি) অবশ্য নিজের কাজে নেমে পড়েছিল। ঋণ বণ্টন সংক্রান্ত কেলেঙ্কারিতে তারা শরদ পওয়ার ও মহারাষ্ট্র স্টেট কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্কের ৬০ জন ডিরেক্টরের বিরুদ্ধে এফআইআর দাখিল করে। সমবায় সংস্থাকে, বিশেষত আখচাষের সমবায় সংস্থাকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে এটিই রাজ্যের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। আর তাই, শরদ পওয়ারের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হল কেন, সেটা বোঝা মুশকিল, তিনি এই শীর্ষ ব্যাঙ্কটির পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন না। শ্রীপওয়ার অবশ্য সামনের পায়ে খেলেন। সোজা ঘোষণা করে দেন, তিনি মুম্বইয়ে ইডি-র দফতরে যাবেন, তাদের সঙ্গে তদন্তের কাজে সব রকম সহযোগিতা করবেন। এবং জানান যে তিনি যদিও কখনও জেলে যাননি, এখন এক বার সেই অভিজ্ঞতা হলে তাঁর আপত্তি নেই। তিনি এই অবস্থান নেওয়ায় ভাল রকম সাড়া পড়ল। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর সমর্থকরা, বিশেষত এনসিপি-র কর্মীরা হাজির হলেন মুম্বইয়ে। ইডি অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে। শ্রীপওয়ারের ইমেল-এর উত্তরে ইডি জানাল, তদন্তের কাজে যখন যেমন প্রয়োজন হবে, তাঁকে দফতরে ডেকে নেওয়া হবে। মুম্বইয়ের পুলিশ কমিশনার শ্রীপওয়ারকে অনুরোধ করলেন, তিনি যেন ইডি-র দফতরে যাওয়ার পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখেন, কারণ তা হলে শহরে আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। শ্রীপওয়ার কর্মসূচি স্থগিত রাখতে রাজি হলেন। তাঁর সমর্থকরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন বন্ধ রাখলেন।
এটা অবশ্যই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে নৈতিক জয়। ভোটের ফলাফলেও তার ছাপ পড়েছে। কংগ্রেস বা এনসিপি ছেড়ে শিবসেনা বা বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন পুনর্নির্বাচিত হতে, এমন ১৯ জন নেতা এই ভোটে হেরেছেন। সাতারা কেন্দ্রে লোকসভা উপনির্বাচনের ফলাফলটিই সবচেয়ে বড় জয়। সেখানে এনসিপি-র সাংসদ ছিলেন শিবাজির বংশধরদের ১৩তম প্রজন্মের প্রতিনিধি উদয়ন ভোঁসলে। এনসিপি ছেড়ে তিনি বিজেপিতে যোগ দিয়ে উপনির্বাচনে দাঁড়ালেন এবং এনসিপি প্রার্থী শ্রীনিবাস পাটিলের কাছে বিপুল ভোটে হারলেন। এনসিপি-র আসনসংখ্যা গত বারের ৪১ থেকে বেড়ে দাঁড়াল ৫৪। কংগ্রেসও ৪৪টি আসন জিতে নিজেদের শক্তি অটুট রাখতে সক্ষম হল।
ফল প্রকাশের পর শিবসেনার দরকষাকষির ক্ষমতা এক লাফে অনেক বেড়ে গেল। তাতে বিজেপি মুশকিলে পড়বে। আরও মুশকিলে পড়বেন দেবেন্দ্র ফডণবীস। রাজ্যে শাসক জোটের সঙ্গী হয়েও শিবসেনা প্রধানমন্ত্রী কৃষি ফসল বিমা যোজনার মতো বিভিন্ন প্রশ্নে ফডণবীস ও মোদী সরকারের সমালোচনা করেছে প্রকাশ্যে— বিরোধী দলের মতোই। এ বার শিবসেনা সম্ভবত উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ দাবি করবে। তার সঙ্গে চাইবে স্বরাষ্ট্র, শক্তি, সেচ বা পূর্ত দফতরের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্ব।
এর পাশাপাশি, বিজেপির অভ্যন্তরে ফডণবীস-বিরোধী নেতারা শক্তিশালী হতে চলেছেন। গত দফায় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন বিনোদ তাওড়ে। এ বার ফডণবীস তাঁকে টিকিটই দেননি। প্রয়াত বিজেপি নেতা ও প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ মুণ্ডের কন্যা পঙ্কজা মুণ্ডে যাতে ভোটে না জেতেন, সেই ব্যবস্থা পাকা করেছেন। ফডণবীসের কোপে পড়েছিলেন রাজ্য বিধানসভায় প্রাক্তন বিরোধী দলনেতা ও বিজেপির প্রবীণ নেতা একনাথ খাড়সের কন্যা রোহিণী খাড়সেও। ভোটে হেরেছেন তিনি। এ বার দলের অভ্যন্তরে তাঁরা চেপে ধরবেন ফডণবীসকে। গত দফায় যে স্বাধীনতা তিনি পেয়েছিলেন, এ বার সম্ভবত সেটা তাঁর ভাগ্যে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy