Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪

এই ‘পৌরুষ’ই তা হলে জনপ্রিয়?

শরীর কারও কেনা সম্পত্তি নয় যে অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করলে তা অশুদ্ধ ও অগ্রহণীয় হয়ে যাবে।

শ্রীদীপ
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

সত্তর কোটি টাকায় তৈরি ছবি প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকার বাণিজ্য করে ফেলেছে। ‘কবীর সিং’ এখন শুধু চলচ্চিত্রের নায়কের নামে আটকে নেই, রীতিমতো আইকন। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তুমুল জনপ্রিয়তা, শুধু পুরুষ দর্শকই নন, মেয়েরাও ভিড় করে আসছেন এ ছবি দেখতে। নারী-পুরুষের সম্পর্কে পুরুষই যে শেষ কথা বলবে, আগাগোড়া মেয়েটিকে মনে-শরীরে দু’দিক থেকেই নিয়ন্ত্রণ করবে, এমন ভাবনা দর্শক হিসেবে মেয়েদেরও আকর্ষণ করছে কেন, বলিউডের মূলধারার ছবিটির সাফল্য দেখে চিন্তা সেখানেই।

এ ছবির নায়ক কবীর ‘পৌরুষ’-এ বিশ্বাসী, কারও ‘সম্মতি’র পরোয়া করে না। চাকু দেখিয়ে এক মহিলাকে বিবস্ত্র করতে উদ্যত হয় প্রথম মিলনেই। ফ্ল্যাশ ব্যাকে দেখতে পাই, প্রেমে পড়েই কলেজে বিজ্ঞপ্তি জারি করে— যে তার পছন্দের মেয়েটির দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করবে, তার কপালে দুর্ভোগ। প্রথম সারির ছাত্রীদের সরিয়ে প্রেমিকাকে ফার্স্ট বেঞ্চে এনে বসায়। এ সমস্ত সিদ্ধান্তে তার প্রেমিকার বিশেষ ভূমিকা নেই, তার সম্মতির কোনও প্রয়োজন নেই। তার ভাল লাগা না-লাগারও কোনও প্রশ্নই আসে না। নায়িকার সংলাপও খুব কম, কারণ সবেতেই তার নিশ্চুপ সায়। দখলদারিতেই অভ্যস্ত কবীর, ফলে সে বুঝেও বুঝতে চায় না যে সম্মতি ছাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ার অর্থ নিজেকে আরোপিত করা— এতে আর যা-ই থাকুক বীরত্ব নেই, যেটা আছে সেটা কোনও বিচারেই অপরাধের বাইরে নয়— ‘মি টু’র আগেও না, পরেও না।

বাইকে স্লো মোশনে চুল উড়িয়ে, কখনও বা পিকনিকে গিটার বাজিয়ে, ডাক্তারি পড়া শেষ হলে বিএমডব্লিউ গাড়ি চড়ে, বুক চিতিয়ে কবীর সম্বন্ধ করতে যায় প্রেমিকার বাড়ি। মেয়ের বাবা বিয়েতে আপত্তি করলে কবীর স্বভাবতই গর্জে ওঠে, তার আত্মাভিমানে চোট লাগে, তার শরীরে জেগে উঠে তেজ। কান্নারত নায়িকাকে সে বাপের বিরুদ্ধে ‘পুরুষ’-এর মতো প্রতিরোধ করতে বলে। আর হম্বিতম্বি দেখিয়েও কাজ না হওয়ায় কবীর আরও রুষ্ট হয়ে রাগে ফেটে পড়ে এবং প্রেমিকাকে তাচ্ছিল্য করে বলে— ‘আমি ছাড়া তুই কে বে!’ তার পর প্রেমিকার গায়ে হাতও তোলে (চড়থাপ্পড় না মারলে নাকি প্রেমের তীব্রতা ব্যক্ত হয় না— ছবিটির পরিচালক বলেছেন সম্প্রতি)। প্রেমিকাকে গৃহত্যাগ করার জন্য ছ’ঘণ্টা সময় দিয়ে বাড়ি ফিরে মাদকদ্রব্য ঠুসে জ্ঞান হারায় কবীর, হুঁশ ফেরার পর জানতে পারে প্রেমিকা হাতছাড়া হতে চলেছে— সে এখন বিয়ের পিঁড়িতে। তখন আবার রাগ, জোশ, হাতাহাতি, ভাঙচুর, গণধোলাই ইত্যাদি।

শরীরটা কোনও ঔপনিবেশিক পরিকল্পনা নয়, যে পতাকা পুঁতবে আজীবন তার, বা ইচ্ছে করলেই আগ্রাসী হওয়া যায় তার উপর। আধিপত্য জাহির করে, গায়ের জোর খাটিয়ে, ধমকে, দাবড়ে সাম্রাজ্যবাদ হয়, প্রেম নয়। কিন্তু এ সব কথা মেনে নেওয়া মানে তো পুরুষ-আধিপত্যের বিরোধিতা করা। পরিচালক তাই উজাড় করে মুক্ত হস্তে কবীরের প্রতি দরদ ঢালছেন আর কবীর আত্মমগ্ন হয়ে যন্ত্রণা ভোগ করছে, বাকি সবাইকেও যন্ত্রণা দিচ্ছে। ও-দিকে দর্শকও দুঃখ-ভোগ-বিলাসে বুঁদ হয়ে থাকা কবীরের শহিদ হওয়ার মেলোড্রামা গিলছে।

শেষ দৃশ্যে অবশ্য মিলন অনিবার্য, নায়িকা তার সতীত্ব বজায় রেখেই দীর্ঘ বিরহের অন্তে ধরা দেবে কবীরের বুকে। পরপুরুষের স্পর্শ তাকে ‘টাচ’ পর্যন্ত করেনি, তা সে জানিয়ে দেয় কবীরকে। গর্ভে কবীরেরই সন্তান নিয়ে গদগদ কাঁদোকাঁদো চিত্তে সে এত কাল অপেক্ষা করছিল নায়কের পুনরাবির্ভাবের জন্য। তার পর তো হাসিখুশি মার্কা পারিবারিক ফ্রেমে খচাত করে ‘শাটার’ ফেলার শব্দ আছেই।

শরীর কারও কেনা সম্পত্তি নয় যে অন্য কেউ সেখানে প্রবেশ করলে তা অশুদ্ধ ও অগ্রহণীয় হয়ে যাবে। কিন্তু পিতৃতন্ত্রের শর্ত অনুযায়ী অহঙ্কারী পুরুষ নিজের নারীসঙ্গের লম্বা তালিকা গড়বে, অথচ প্রেমিকার সতীত্ব অক্ষত থাকতে হবে। এই ধরনের ‘ক্ষমতা’ই পিতৃতন্ত্র প্রকাশ করে এসেছে বরাবর, আর বলিউডের বাজার তার প্রশস্ত ক্ষেত্র।

পর্দায় অহেতুক আগ্রাসন কী ভাবে ও কতটা প্রেক্ষাগৃহের বাইরে ছায়া বিস্তার করে,

এই ছবি তারই হাতেনগদ প্রমাণ। ক্রোধ ও হিংস্রতার মাধ্যমে নিজেকে আরোপিত করার প্রবণতা যখন বিপুল গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে সেটা উদ্বেগের বিষয়— বিশেষ করে বর্তমান রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই।

আসলে মূলধারার হিন্দি ছবিতে সেই গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকেই দেখে আসছি আমরা, নায়িকার জন্যে পাগল পুরুষেরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও লড়ে যাচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত নায়িকার জন্যে প্রকট হয়ে উঠছে তাদের বিয়ে বা দাম্পত্যের চাহিদা। সে জন্যেই এত হিংসা, ক্রোধ, দাপট, দখলদারি। সত্তরের দশকের ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’-এর একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছিল। সে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী, তার ক্রুদ্ধ স্বর উপেক্ষিত ও অবহেলিত মানুষের আওয়াজ। কিন্তু আভিজাত্যে-মোড়া কবীরের রাগের উৎস কী? কেনই বা বাকিরা তার ফাঁপা ‘মাচো’গিরি সহ্য করে?

নব্বইয়ের দশকে আস্তে আস্তে বলিউডি নায়কদের বেশ খানিকটা তাদের উদ্দাম পৌরুষ থেকে সরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলেন ছবির পরিচালকেরা। যেন অনেকটাই নরম স্বভাবের সংবেদনশীল পুরুষ হয়ে উঠতে চাইছিল নায়কেরা, নায়িকাদের মন জয় করতে চাইছিল বন্ধুত্ব দিয়ে, গায়ের জোরে নয়। কবীর সিং ফের পৌঁছে গেল উদ্ধত, অপরিণামদর্শী পৌরুষে! চার পাশের অসহিষ্ণু সময়ের চাপে পড়েই কি? কারণ যা-ই হোক, যে পরিচালক ছবিটা তৈরি করেছেন, আর যাঁরা ছবিটা দেখে হাততালি দিচ্ছেন, তাঁদের বোঝা দরকার যে পৌরুষের এই চেহারাটা ‘কুল’ নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Kabir Singh Shahid Kapoor Bollywood
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy