ছবি: সংগৃহীত
ভারতীয় সংবিধানে ভারতীয় রাজ্য সংসদকে একটি সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে পূর্ণ স্বরাজের সংকল্প গৃহীত ও ঘোষিত হয়েছিল। সেই দিনটিকে স্মরণে রেখে ১৯৫০-এর ২৬ জানুয়ারি দিনটি সংবিধান কার্যকর করা হয়।
সংবিধানে সরকারের গঠন ও কার্যপদ্ধতি, ক্ষমতা ও কর্তব্য নির্ধারণ, মৌলিক অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশমূলক নীতি ও নাগরিকদের কর্তব্য নির্ধারণের মাধ্যমে দেশের মৌলিক রাজনৈতিক আদর্শের রূপরেখাটি নির্দিষ্ট করা হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী এ দেশের নাগরিকদের জন্য ন্যায় বিচার, সাম্য ও স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করা হয়েছে এবং জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য নাগরিকদের পারস্পরিক ভাতৃভাব জাগরিত করার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। ‘সমাজতান্ত্রিক’, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘সংহতি’ এবং সকল নাগরিকের মধ্যে ‘ভাতৃভাব’—এই শব্দগুলি ১৯৭৬ সালে সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত করা হয়।
ভারতীয় সংবিধানের রূপকার বি আর অম্বেঢকর অনুভব করেছিলেন, দেশের অনুন্নত শ্রেণির, বিশেষত তফসিলি জাতি ও জনজাতির অন্তর্ভুক্ত মানুষজনের উন্নতি না হলে দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি সম্ভব নয়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতির বৈচিত্রের দরুন দেশের সত্যিকারের সাম্য আনতে গেলে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির উন্নয়ন সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এ জন্য সংবিধান চালু হওয়ার প্রথম দশ বছর তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হোক।
তবে দশ বছর কেন, প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা লাভের ৭২ বছর পার হয়ে গেলেও এখনও সংরক্ষণের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বাস্তবিক অর্থে চরম আর্থিক বৈষম্যের কারণে কেবলমাত্র আলোকপ্রাপ্ত বা স্বজ্জ্বল সংরক্ষিত পরিবারের সন্তানেরাই এই সংরক্ষণের সুবিধা নিতে পারছেন। বাকি ব্যাপক অংশ প্রদীপের নীচে অন্ধকারের মধ্যে বাস করছেন। দেশের উন্নতির জন্য প্রকৃত অর্থে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর সর্বস্তরের দরিদ্র মানুষেরই এই সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া উচিত। কিন্তু আজ পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দলই প্রকৃত উন্নয়নের কথা না ভেবে কেবল ভোট-ব্যাঙ্ক বজায় রাখার জন্যই সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু রাখা তথা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে চলেছে। ফলে, দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি ব্যাহত হচ্ছে।
ভারতের সংবিধান রাষ্ট্র, সরকার ও নাগরিকদের কাছে ধর্মগ্রন্থের মতো পবিত্র হিসেবে মানা উচিত। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও উদ্বেগের বিষয় বর্তমানে সংবিধান-স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে ভাগ করার চেষ্টা চলছে। প্রকৃতপক্ষে ‘সিএএ’ সংবিধানের চতুর্দশ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সমানাধিকার, একুশতম অনুচ্ছেদে প্রদত্ত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার ও পঁচিশতম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্মাচরণের অধিকারের পরিপন্থী। এ ধরনের আইন সংবিধানের মূল ভাবনা ধর্মনিরপেক্ষতারও বিরোধী। সংবিধানের একাদশ অনুচ্ছেদের ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে কেন্দ্র সরকার নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে।
তবে মনে রাখা প্রয়োজন, এই অনুচ্ছেদ কেন্দ্রকে লাগামছাড়া ক্ষমতার অধিকারী করে না, যেহেতু এই আইন সংবিধানের চতুর্থ ও পঞ্চদশ অনুচ্ছেদের বিরোধী।
এ কথা ভুললে চলবে না যে প্রতিবাদ সাংবিধানিক অধিকার। মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কেউই ধর্মের ভিত্তিতে জাতির বিভাজন মেনে নেননি। হিন্দু-মুসলিমের গোলমাল থামাতে অশক্ত শরীরেও নোয়াখালি ও কলকাতায় ছুটে গিয়েছেন গাঁধী। স্বামী বিবেকানন্দ সর্বধর্মে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে সর্ব শ্রেণির মানুষকে আপন করে নিতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে—/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।” পূর্ণ ভারতভূমির সেই সংস্কৃতিকে আমরা বিসর্জন দেব কেবল ভোটের কারণে? মানুষ আর ভোটার আজ সমতুল্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃত ধর্মজ্ঞানীর কাছে যেমন মানুষই ভগবান, তেমনই রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষই ভোটার।
দেশের অর্থনীতির হাল চরম দুর্দশাজনক। বেকারদের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম। বহু টাকা ব্যয় করে আধার কার্ড, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড ইত্যাদি তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে নাগরিক পঞ্জি তৈরি করার কোনও সার্থকতা আছে কি? এ দিকে শয়ে শয়ে ধর্ষণ কাণ্ডে কেবল এফআইআর দায়ের করতেই কেটে যাচ্ছে মাসের পরে মাস। নারী ও শিশু নির্যাতন নিত্য ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে। জল-দূষণ, বায়ু-দূষণ সহ্যের সীমা ছাড়াচ্ছে।
এই সময়ে দাঁড়িয়ে সমস্ত রাজনৈতিক মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে সচেতন যুব সমাজকে এগিয়ে এসে প্রতিবাদী কণ্ঠে সরব হতে হবে। বলতে হবে ধর্ম, বর্ণ, ভাষার নামে আর রাজনীতি নয়। ভোটের প্রয়োজনে কেবলমাত্র ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে বিশেষ ভাবে তোল্লাই দেওয়া বন্ধ হোক। থামুক ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ, হানাহানি।
লেখক বাঁকুড়া জিলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যাপীঠের অধ্যক্ষ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy