পুনরর্জন: নতুন করে আজ়াদি উচ্চারণ, নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, রাঁচী, ১৯ জানুয়ারি। পিটিআই
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলে আজকাল কত কী নতুন! আগে কখনও দেখিনি, এমন কত কী ঘটে চলেছে এখানে ওখানে। এই যেমন, রাত দশটায় মধ্য কলকাতার এন্টালির ফাঁকা-হয়ে-আসা রাস্তায় দেখি ট্রাক-ভর্তি ছেলেমেয়ে, হাতে তাদের একটাই পতাকা— ভারতের ত্রিবর্ণ নিশান, মুখে তাদের একটাই স্লোগান— আজ়াদি! মাচাবাঁধা প্রতিবাদ-সভায়, খোলা আকাশের নীচে ধর্নাতেও একই স্লোগান, একই পতাকা। রাস্তার কোণে কোণে জ্বলজ্বল করছে তিনটি অক্ষর: সেভ দ্য কনস্টিটিউশন! হঠাৎ বিভ্রম ঘটে, কোন শতকে কোন দশকে যে আছি, ব্রিটিশের কাছ থেকে আজ়াদি ছিনিয়ে নেওয়ার সময়েই না কি! অদ্ভুত সময় এখন।
কয়েক দিন আগে শহরে এক অনুষ্ঠানে অনেক স্কুলের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছে অনেক সদ্যোজাগ্রত কিশোরকিশোরী। বাইরের শহরের স্কুল থেকেও: আজমেঢ় কিংবা পুণে। গঙ্গাতীরে সন্ধ্যালোকে সেই অনুষ্ঠানে ভিন্-শহর থেকে আসা ছেলেমেয়েগুলির মধ্যে সে কী তীব্র মহৎ রাগ— বলছে তারা, এই দেশকে প্যালেস্তাইন হতে দেবে না, নষ্ট হয়ে যেতে দেবে না, সংবিধানকে তারা বাঁচাবেই। অজান্তেই উদ্বেগ হল, অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে তো লেখা ছিল রাজ্যপাল এসে উদ্বোধন করবেন, তাও এই সব সাংঘাতিক কথা? উদ্বিগ্ন আমি আঙুল কামড়াচ্ছি, আর ভয়ডরহীন টানটান পনেরো-ষোলো বছরগুলো মঞ্চের উপর দাপিয়ে বলছে কাশ্মীরের কথা, আসিফার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উপর অত্যাচারের কথা, নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়ার আতঙ্কের কথা। নিজেদের পা থেকে সমস্ত শরীর টেপ দিয়ে বেঁধে ফেলে দেখাচ্ছে তারা দেশের মানুষের হাল। গরিব মানুষের হাল। মুসলিম বা দলিত বা আদিবাসীদের হাল। তাদের অসম্ভব বুকভাঙা এমপ্যাথি— দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এরা যে ভাবে দেশকে বুঝছে, এদের বাবা-মায়েরা কোনও দিন সেই সুযোগ পেয়েছিলেন কি? পেয়েছিলাম কি? অদ্ভুত সময় এখন।
আগামী রবিবার সত্তর বছর পূর্ণ হবে আমাদের প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের। কম বয়স নয়। এই যথেষ্ট লম্বা সময় পেরিয়ে নতুন করে আজ়াদি উচ্চারণের সময় যে এল, তাতে আমাদের লাভ না ক্ষতি?
এটা ভাবাটাই এখনকার সময়ের একটা জরুরি কাজ হতে পারে। ব্যাপারটা সহজ নয়। সত্তর বছর ধরে আমরা ভেবে এসেছি, এমন এক দেশে আছি যা শুধু গণতন্ত্র নয়, তার চেয়ে আরও বেশি কিছু। ভেবে এসেছি, গণতন্ত্র আর প্রজাতন্ত্র মিলিয়ে এই দেশ হল কেবল জনগণের সম্পদ— রাজার রাজত্ব নয়, নেতার মৌরসিপাট্টা নয়। হয়তো ভুল ভেবেছি। ভোট দেওয়ার সময় রাষ্ট্রের সঙ্গে এক বিপুল সংখ্যার জনসাধারণের সংযোগের কথা ভেবে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়েছে। ভেবেছি, এ তো ইউরোপ আমেরিকা নয়, আসমুদ্রহিমাচলের খেতে-না-পাওয়া, নিজের নামটুকু পড়তেলিখতে-না-পারা, গায়ে শীতের কাপড় দিতে-না-পারা, মাথার উপর পাকা ছাউনি জোগাড় করতে-না-পারা কোটি কোটি মানুষ এ দেশে বলে দিতে পারেন কী তাঁরা চান, কোন সরকার আনতে চান। ভেবেছি, শিক্ষা-অশিক্ষা, ধনী-নির্ধনের ব্যবধান দূর করে দিতে পারে আমাদের মানুষের বোধের দীপ্ততা; তাই জরুরি অবস্থার নেত্রী বা গুজরাত দাঙ্গার নেতা বিরাট ভোটে বেবাক হেরে যেতে পারেন।— হয়তো একটু বেশিই ভেবেছি।
তরুণ ইতিহাসবিদ রোহিত দে তাঁর আ পিপলস কনস্টিটিউশন বইয়ের কেন্দ্রীয় বক্তব্য হিসেবে বলেছেন: উনিশশো সাতচল্লিশের স্বাধীনতা তো নয়, উনিশশো পঞ্চাশের সংবিধান দিবসই এই দেশে মানুষের জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দেয়। সরকারের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্কটা এমন সরাসরি করে। নাগরিকের প্রাত্যহিক জীবনে সংবিধান যেন তার অলক্ষ্য ছাপ রেখে যায়, তা সম্ভব করে। সাধারণ মানুষ যে আজও বেকায়দায় পড়লে বিচার চায়, তার মানেই তো সে সংবিধানের কাছে আশ্রয় চায়! শাসনের উপর নয়— বিচারের উপর এই আস্থা কখনও নড়ে যায়নি তা নয়, কিন্তু তবু সাংবিধানিকতা আমাদের সাত দশকের গৌরবের ধন হয়ে থেকেছে। সরকার বেয়াদবি করলেও সংবিধানের ভর্ৎসনায় তাকে ঠান্ডা করে দেওয়ার আশা আমাদের ঘুচে যায়নি। কে জানে, হয়তো ভুলই ছিল সেই আশা।
অদ্ভুত সময়ই বটে। সুতরাং গোড়া থেকে সব আবার নতুন করে ভাবতে বসার সময়। কেননা, কে নাগরিক সেটাই যে এখনকার সরকার নতুন করে ঘোষণা করতে চায়। এত দিন নিজেদের নাগরিক ভেবে এসেছি যারা, তাদের সকলকেই নতুন করে পরীক্ষায় পাশ করে নাগরিকত্বের সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হবে। সত্তর বছর পর হঠাৎ অনেকটা উঁচু থেকে সটান মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ার মতো। হঠাৎই বুঝলাম আমরা, নাগরিকের তুলনায় সরকারের ক্ষমতা কতখানি বেশি আর উঁচু হলে এই ভাবে মানুষকে মাটিতে আছড়ে ফেলা যায়।
শাসক সরকার যে এমন আশ্চর্য তৎপরতায় আমাদের নাগরিকত্ব তথা সংবিধানকে ‘অলীক’ বানিয়ে দিল, এটা নিশ্চয় আকস্মিক ঘটনা নয়, নিশ্চয় এরও লম্বা একটা প্রস্তুতিপর্ব আছে— ক্রমে বুঝতে পারব। বিশেষজ্ঞেরা আমাদের বুঝিয়ে বলবেন। মনে তো পড়েই যে, যখন এই দেশের সংবিধান তৈরি হচ্ছিল, তখনও এ নিয়ে টেনশন কম ছিল না। রোহিত দে-র বইতে পড়ি জ়য়রুল হাসান লারি-র কথা। মুসলিম লিগের সমর্থক হয়েও তিনি ভারতীয় মাটিকে বেছে নিয়েছিলেন, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলির (গণপরিষদ) সদস্য ছিলেন, তার পর সংবিধান চালু হওয়ার আগেই আবার পাকিস্তানে চলে যাওয়া মনস্থ করেছিলেন। গণপরিষদের চেয়ারপার্সন অম্বেডকর যখন সাংবিধানিক নৈতিকতার উপর জোর দিয়েিছলেন, বলেছিলেন যে এটা কোনও স্বাভাবিক বোধ নয় যা মানুষের মধ্যে এমনিই থাকে, অনেক ধৈর্য নিয়ে যত্ন নিয়ে মানুষের মধ্যে এই বোধ তৈরি করতে হয়— অম্বেডকরের সেই উঁচু-থেকে-নিচুর প্রতি দায়িত্বের কথা মেনে নিয়েও লারি একটা গুরুতর শর্ত যোগ করেছিলেন। ‘উঁচু’র জন্যই সেই শর্ত। বলেছিলেন, কেবল সাধারণ মানুষ কেন, সরকার-এর মধ্যেও এই নৈতিকতা স্বাভাবিক ভাবে থাকার কথা নয়। ‘সরকার’কেও সাংবিধানিক নৈতিকতা নামক বিষয়টা শিখতে হবে। মানুষ যখন বিচারবিভাগের মাধ্যমে শাসনবিভাগকে প্রশ্ন করবে, সমালোচনা করবে, চ্যালেঞ্জ করবে, তখন সরকারকেও তা যথাযথ ভাবে গ্রহণ করতে হবে, আত্মসংশোধন করতে হবে। অর্থাৎ সাংবিধানিকতা একটা দ্বিমুখী বিষয়, একমুখী নয়।
অসাধারণ কার্টুন এঁকেছিলেন রাজনৈতিক ব্যঙ্গশিল্পী শঙ্কর, ১৯৫৫ সালের ২০ মার্চ: একটি বিরাট স্তম্ভ (সংবিধান), তার এক দিকে একগাদা ইঁদুর (আইনজীবী) লাফালাফি করতে করতে স্তম্ভের মধ্যে একটার পর একটা ফুটো করে চলেছে, আর অন্য দিকে কাঠের তক্তা আর হাতুড়ি-পেরেক হাতে ‘কাজ’ করছেন ব্যস্তসমস্ত জওহরলাল নেহরু— ফুটোয় কাঠের তাপ্পি দেওয়ার কাজ! ছবিতে না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না, ইঁদুরগুলি এইসা তরতাজা ছটফটে থাকতে পারছে, তাদের পিছনে যারা আছে তাদের জন্যই: এদেরই নাম নাগরিক! প্রজাতন্ত্রের এর থেকে শক্তিশালী ছবি ভাবা যায় না!
এই মুহূর্তে অবশ্য প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে— অস্তিত্বের। নাগরিক নই তো এই দেশে এত দিন কোন হিসেবে আছি, নাগরিক নই তো ভোট দিচ্ছি কী করে, সেই ভোটে আপনারা জিতে সরকার গড়ছেন কী করে, কর দিচ্ছি কোন পরিচয়ে— সবই মৌলিকতম জিজ্ঞাসা। প্রতিবাদীদের কারও হাতে সে দিন একটা প্ল্যাকার্ড দেখলাম, লেখা আছে, ‘যদি ভোটার কার্ড আমার পরিচয় না হয় তা হলে গদি ছাড়ো, যদি আধার কার্ড আমার পরিচয় না হয় তা হলে ব্যাঙ্কে তা দিতে বোলো না, যদি প্যান কার্ড আমার পরিচয় না হয় তা হলে আমার এত দিনের দেওয়া কর ফেরত দাও।’ নাগরিকত্বের অধিকারের গোড়াটা ধরেই টান পড়েছে— আজ়াদি-র ডাক তো উঠবেই!
যদিও এটাই একমাত্র কথা নয়। যখন নাগরিকের তথ্যের অধিকারে আঘাত এসেছিল, যখন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় টান পড়েছিল, যখন নাগরিকের নিজের হাতের টাকা রাতারাতি অচল করে দেওয়া হয়েছিল, যখন নাগরিকের ব্যক্তিপরিসরে জেনেবুঝে কোপ মারা হয়েছিল, প্রতি বারই চূর্ণ হয়েছিল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার, যা সংবিধান অনুযায়ী প্রথম থেকেই কোনও কাগজের উপর নির্ভরশীল ছিল না। অর্থাৎ সরকারের অধিকারের প্রেক্ষিতে নাগরিকের অধিকার অনেক বেশি দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছিল। যে শক্ত জমিটায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি বলে ভেবেছিলাম, কয়েক বছর ধরে তা কুপিয়ে কুপিয়ে গর্ত করে দেওয়া হয়েছে। পড়ে তো আমরা যাবই!
আজ তাই বিরাট দায়িত্বের কাজ সামনে। নিজেদের ভারতীয় বলে প্রতিষ্ঠা করা, এবং সেই সূত্রে, ভারতের নিজস্ব পরিচয়টা প্রতিষ্ঠিত রাখা। ১৯৪৭-এর পর ২০১৯, আজ স্বাধীনতার দ্বিতীয় সংগ্রাম কি না বলতে পারি না। তবে, ১৯৫০-এর পর ২০১৯, এটা প্রজাতন্ত্রের দ্বিতীয় সংগ্রাম, অবশ্যই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy