সংঘাত: গণশত্রু ছবিতে রাজনীতি ও ধর্মব্যবসার মারাত্মক আঁতাঁতকে চিহ্নিত করেছিলেন সত্যজিৎ রায়
ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ সারা জীবন মছলিবাবাদের ঘোরতর অপছন্দ করতেন। ধর্মের নামে লোক-ঠকানো আর বাবাজিগিরি করা তাঁর একেবারেই সইত না।
১৯৪০-৪১। শান্তিনিকেতনের কলাভবনে পড়তে গিয়েছেন তিনি, রবীন্দ্রনাথ তখন অস্তবেলায়। শান্তিনিকেতন থেকে মাকে লেখা চিঠিতে এক সাধু প্রসঙ্গে তরুণ সত্যজিতের রাগ স্পষ্ট ভাষায় প্রকাশিত। ‘‘তোমার Blood sugar বেড়েছে জেনে বুঝলাম ওই সাধু একেবারে ভণ্ড। ...তুমি আর সাধুর কথামত খাওয়া দাওয়া ইত্যাদি করছ না তো?’’ ভণ্ড-সাধুদের প্রতি এই রাগ স্রষ্টা সত্যজিৎ আজীবন বহন করতেন বলেই জয় বাবা ফেলুনাথ (১৯৭৯) ছবিতে ফেলুদা সৌমিত্র— ভণ্ড বাবাজি আর তাঁর কর্তা কুখ্যাত মগনলাল— দু’জনের খেল খতম করে দেন।
পরশুরামের বিরিঞ্চিবাবা-গল্পের চিত্ররূপ মহাপুরুষ (১৯৬৫) এর আগেই তৈরি করেছিলেন সত্যজিৎ। ‘অপবিজ্ঞান’ নিবন্ধে রাজশেখর পরশুরাম বিজ্ঞানের ভেকধারী ধর্মবাজদের মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। উনিশ শতকের হিন্দু-পুনরুত্থানবাদের হাত ধরেই এই বিজ্ঞান-বাবাজিদের রমরমা। বিবেকানন্দ ঠাট্টা করে লিখেছিলেন, ‘দুর্গাপূজার বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা হতে মায় কাদা পুনর্ব্বিবাহ দশ বৎসরের কুমারীর গর্ভাধান পর্য্যন্ত সমস্ত বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করতে’ এঁরা নাকি অদ্বিতীয়!
উনিশ শতকে শশধর তর্কচূড়ামণি অগস্ত্যমুনির সমুদ্রশোষণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যা দিতেন! অগস্ত্যের রাগী চোখ থেকে নাকি বিদ্যুৎ ঠিকরে বাইরে এল। আর সমুদ্রের জল এক নিমেষে বিশ্লিষ্ট হয়ে হাইড্রোজেন-অক্সিজেন রূপে উবে গেল। এমন বাহাদুর হিন্দুত্ববাদী মগজই এ কালে আবার রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণায় মাঝে মাঝেই জেগে ওঠে। হাতি-মুখো গণেশ তখন প্লাস্টিক সার্জারির মোক্ষম প্রাচীন ভারতীয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়। সন্দেহ নেই সত্যজিৎ থাকলে এঁদের দুয়ো দিতেন। রাজনীতির সঙ্গে ধর্মব্যবসার আঁতাঁত হলে সেই সংগঠিত শক্তি কতটা বিপজ্জনক, তা নিয়েই সত্যজিতের প্রান্তবেলার ছবি গণশত্রু (১৯৮৯)। সৌমিত্র সেখানে লড়াকু ডাক্তারবাবু। মন্দির-ব্যবসায়ীরা ও তাঁদের কারবারের রাজনৈতিক শরিকেরা কিছুতেই মেনে নেবেন না মন্দিরের চরণামৃত দূষিত হয়ে গছে, সেই দূষিত চরণামৃত খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। জলের ফেটে-যাওয়া পাইপ ঠিক করে দূষিত জল শোধন করলেই গোল চোকে। কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা জানেন এ কথা স্বীকার করলে তাঁদের প্রভাব-প্রতিপত্তি মার খাবে। সিনেমায় ডাক্তারবাবু সৌমিত্র নির্ভীক চিত্তে যা বলেন, ব্যক্তি-সৌমিত্রও তা-ই বলতেন। ধর্ম ও রাষ্ট্রের অশুভ সংযোগের, সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রের বিরোধী ছিলেন বলে ছাত্রদের প্রতিবাদপত্রে সৌমিত্র এই তো সে দিন নির্দ্বিধ সই করেছিলেন।
ধর্মের এই অনৈতিক ভণ্ডামির প্রতি যেমন সত্যজিতের বিরক্তি ছিল, তেমনই রাগ ছিল সবজান্তা বিজ্ঞানবাদের উপরেও। সত্যজিৎ ভাল করেই জানতেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভেলকি ব্যবহার করে মানুষ ঠকানোর কল তৈরি করা সম্ভব। মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানকে নষ্ট করে বৈজ্ঞানিক ভেলকি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। সত্যজিতের একাধিক ছবিতে আছে ক্ষমতালোভী বিজ্ঞানের ভেলকি প্রসঙ্গ। হীরক রাজার দেশে-র যন্তর-মন্তর ঘরটির কথা মনে নেই? প্রযুক্তির সাহায্যে প্রজাদের মগজধোলাই করে ইচ্ছে মতো মন্ত্র ঢুকিয়ে দেওয়া যায় মগজে। রাজার জয়গান গায় না-খেতে পাওয়া গরিব প্রজা। কণ্ঠরোধকারী রাজার ক্ষমতা বহাল থাকে। সাধে কি সত্যজিতের প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির চাকরি-সন্ধানী বেকার যুবক মানুষের চন্দ্রাভিযানের চাইতে ভিয়েতনামের প্রতিরোধ যুদ্ধকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন! যে রাষ্ট্র মানুষের খাদ্যবস্ত্রের চাহিদাকে গুরুত্ব দেয় না, সেই রাষ্ট্রই পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধু-যুদ্ধু খেলায় মাতে। মানুষের জীবনের সঙ্গে প্রাকৃতিক ভারসাম্যকেও বিনষ্ট করে।
কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিটি যে বছর মুক্তি পেয়েছিল সে-বছরই প্রকাশিত হয়েছিল সাইলেন্ট স্প্রিং। র্যাচেল কারসনের এই বইটিতে ধরা পড়েছিল এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্য পৃথিবীর ছবি। তখন পাখিরা আর বাড়ির পিছনের উঠোনে জল খেতে আসবে না। সত্যজিতের কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবিতে বেকার ছেলেটির সঙ্গে পথ চলতে চলতে পক্ষী-প্রেমী মানুষটি জানান তাঁর উদ্বেগের কথা। পারমাণবিক পরীক্ষার ভয়াবহ ফল নেমে আসবে পরিযায়ী পাখিদের জীবনে। তারা আর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে উড়ে যেতে পারবে না। ঝরে পড়বে মৃত পাখির দল। এই আশঙ্কা ভয় হয়ে, বেদনা হয়ে ঢুকে পড়ে দর্শক-মনে। লোভী ধর্ম আর সবজান্তাভাবাপন্ন বিজ্ঞান যেন আধুলির এ পিঠ-ও পিঠ— ক্ষমতার লোভ, ক্ষমতার দম্ভ ধর্ম আর বিজ্ঞানকে সমগোত্রীয় করে তুলছে।
এর হাত থেকে বাঁচার উপায় কী? জীবনের শেষ ছবি আগন্তুক (১৯৯১)-এ উৎপল দত্তকে নিজের কণ্ঠস্বর হিসেবে ব্যবহার করছিলেন সত্যজিৎ। কলকাতায় ভাগিনেয়ীর বাড়িতে দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পরে হঠাৎ হাজির এক আগন্তুক, অনিলার মামা। ‘অসভ্য’ থেকে আমরা ক্রমে বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির গুণে ‘সভ্য’ হচ্ছি, এ বিশ্বাস তাঁর নেই। পৃথিবী ঘুরে নানা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করে তাঁর সিদ্ধান্ত গুহাবাসী মানুষ শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অধিকারী। ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভি স্ত্রসের রচনা মন দিয়েই পড়েছিলেন সত্যজিৎ। আগন্তুক ছবির বিশ্বচারী মামা ঘর ছেড়েছিলেন ১৯৫৫ সালে, সে বছরই ফরাসি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল লেভি স্ত্রসের নিজের কাজকর্মের জবানি, ১৯৬১ সালে আ ওয়ার্ল্ড অন দ্য ওয়েন নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয় বইটি। সভ্য-আধুনিকরা তাঁদের পূর্বপুরুষদের বর্বর বলে ভাবেন, এরই বিরুদ্ধ কথা বলছিলেন তিনি। তিনি মনে করতেন আদিম-অসভ্য বলে যাঁদের দাগানো হয়, তাঁরা আদপেই ‘অসভ্য’ নন। সত্যজিতের শঙ্কুকাহিনির সেই গুহাবাসী মানুষটির কথা মনে পড়ে: গুহাঘরে পাথর দিয়ে তিনি বানিয়েছিলেন অসামান্য গবেষণাগার।
আধুনিক বিজ্ঞানের বাইরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতর এক স্তরের কথা স্বীকার করলে পুঁজিপন্থী, রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিজ্ঞানের দাপট খানিক কমে, তার দম্ভ চুপসে যায়। সত্যজিতের ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু তো লিখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে, “জটিল যন্ত্র তৈরির ব্যাপারে এখনও প্রকৃতির ধারে কাছেও পৌঁছতে পারেনি মানুষ।” না-পারা দোষের নয়, না-পারা মানে হেরে যাওয়াও নয়। না-পারাটুকু স্বীকার করে নিলে বিজ্ঞানের দম্ভ কমবে, বিস্ময়বোধ জেগে থাকবে।
সত্যজিৎ কখনও চাইতেন না বিস্ময়বোধের মৃত্যু হোক। এই বিস্ময়বোধ ধর্মীয় ভেলকিবাজি দেখে অবাক হওয়া বা বোকা বনে যাওয়া নয়। রবীন্দ্রনাথের গানে যে বিস্ময়ের কথা ছিল এ বিস্ময় তারই সমতুল্য। ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/ আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে’ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ১৮৯৬ সালের গানে। এ গানে ছিল ‘অসীম রহস্যমাঝে’ বসে থাকা বিশ্বনাথের কথা। সে বিশ্বনাথ ধর্মের নামে মানুষকে গ্রাস করেন না। বরং তিনি মানুষের দিকে আর মানুষ তাঁর দিকে চেয়ে থাকে— ‘তুমি আছ মোরে চাহি— আমি চাহি তোমা পানে’, এ আদতে ব্যক্তিগত ঈশ্বরের প্রসঙ্গ। ১৯৩১-এ প্রকাশিত আইনস্টাইনের লিভিং ফিলজ়ফিজ় বইতেও ছিল এই রহস্য আর বিস্ময়ের কথা। তিনি লেখেন, “অসীম রহস্যই হল আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ সুন্দরতম বস্তু... সমস্ত যথার্থ শিল্প ও বিজ্ঞানের উৎস।” যার বিস্ময়বোধ নেই, সে মৃতকল্প, তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। এই বিস্ময় কেবল বিজ্ঞানের জন্ম দেয় না। আইনস্টাইন মনে করেন এই বিস্ময় প্রকৃত ধর্মবোধেরও জন্ম দেয়।
সত্যজিতের আগন্তুক ছবিতেও উঁকি দিয়ে যায় ব্যক্তিগত ঈশ্বরের অনুভব। বিদেশি পুঁজিতে কৃষ্ণের নামে ধর্মীয় সমারোহের যে হুজুগেপনা, তারই উল্টো দিকে উৎপল দত্তের কণ্ঠে পরিচালক সত্যজিৎ স্বয়ং গেয়ে ওঠেন ‘হরিহরায় নমঃ’। না, মাথা নত করে অন্ধ ভক্ত হয়ে ওঠেননি সত্যজিৎ, শুধু খেয়াল করিয়েছিলেন ধর্ম যদি রাখতেই হয়, তবে তা থাকবে মানুষের একান্ত অনুভবের বিস্ময়ে।
সত্যজিৎ প্রতিরোধ করছিলেন পুঁজিনিয়ন্ত্রিত ধর্ম ও বিজ্ঞানকে। আগন্তুক ছবির মানুষটি আবার বেরিয়ে পড়েন ভাগিনেয়ীর আশ্রয় থেকে, ছোট্ট ছেলেটিকে বলে যান কূপমণ্ডূক না হতে। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ধর্ম আর বিজ্ঞান মানুষকে কুয়োর ব্যাঙ বানিয়ে রাখতে চায়। সেই কূপবর্তী রামরাজ্যের বাইরে আসা চাই, বলা চাই, মহাবিশ্বে মহাকাল মাঝে আমি ভ্রমি বিস্ময়ে। বিস্ময় জেগে থাকলে নিজের দম্ভ আর ক্ষমতার লোভ যাবে নিবে, ধর্ম কিংবা বিজ্ঞানের সবজান্তাপনা দিয়ে গিলে ফেলতে ইচ্ছে করবে না অপরকে।
বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy