Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

ভালবাসার অফুরান উৎস

‘নেই’-এর রাজত্বকে সদর্থকতায় পূর্ণায়ত করে তুলতে পারে একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালবাসা— যার প্রতিমূর্তি শ্রীমা সারদা। তাঁর জীবনের সারসত্যটুকুই ছিল ভরপুর ‘ভালবাসা’।

সারাদা দেবী।

সারাদা দেবী।

তাপস বসু
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫৮
Share: Save:

পরিবর্তিত মূল্যবোধ, তলানিতে পৌঁছে যাওয়া নৈতিকতা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও তাকে বেশির ভাগ সময়ে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে ব্যবহার মানুষকে আজ প্রেম-প্রীতি-সৌহার্দ্যের জগৎ থেকে বিচ্যুত করে চূড়ান্ত ভোগবাদী জীবনযাপনে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান সমাজে আমাদের মানবিক হওয়ার প্রয়াস নেই, বিশ্বাস নেই, ভালবাসা নেই, অধ্যাত্মপথের হদিস জানা নেই, চিন্তাচর্চা নেই।

এই ‘নেই’-এর রাজত্বকে সদর্থকতায় পূর্ণায়ত করে তুলতে পারে একমাত্র নিঃস্বার্থ ভালবাসা— যার প্রতিমূর্তি শ্রীমা সারদা। তাঁর জীবনের সারসত্যটুকুই ছিল ভরপুর ‘ভালবাসা’। এ যেমন তাঁর পারিবারিক জীবনে— যেখানে তিনি চন্দ্রমণিদেবীর পুত্রবধূ বা পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের লজ্জাপটাবৃত স্ত্রী, এলোমেলো-চূড়ান্ত অগোছালো অনুজদের দায়িত্বপরায়ণা অগ্রজা। অন্য দিকে রামকৃষ্ণসঙ্ঘের ‘জননী’— রামকৃষ্ণপার্ষদ-সহ অগণিত সন্ন্যাসী ও গৃহী সন্তানের ‘মা’। সেই কবে তাঁর স্বামী কাশীপুর বাগানবাড়ি থেকে তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজধানী কলকাতার দিকে আঙুল তুলে সেখানকার লোকজনের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই ওপর। তার পর শুধু কলকাতার কেন; তাবৎ বিশ্বের লক্ষ কোটি মানুষের জননী তিনি। উচ্চারণ করেছেন, ‘সব সময় মনে রেখো, তোমাদের এক জন মা আছেন। সেই মা, পাতানো নন, গুরুপত্নী নন, কথার কথা মা নন, সত্যিকারের মা।’

পারিবারিক জীবনকে, আধ্যাত্মিক ভাবভূমিকে সুসংহত-সুগঠিত করার জন্য নিজের জীবনটি তিনি মেলে ধরেছিলেন। কী নেই সেখানে! দক্ষিণেশ্বরে ভোর-ভোর প্রাত্যহিক কাজ শেষ করে রান্না বসানো, স্বামীর জন্য একটু ‘জিওল’ মাছের আয়োজন, শাশুড়ির যত্নআত্তি; শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে আগত অনেক জ্ঞানী-গুণী, নগর কলকাতার তাবড় তাবড় লোকজন— তাদের দেখভাল; অল্পবয়সি, যাদের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ, রাখাল, লাটু অগ্রগণ্য— তাদের জন্যও একহাত ঘোমটা মাথায় টেনে, রুটির ময়দা ঠাসছেন। রাঁধছেন ছোলার ডাল। আবার ওরই মধ্যে চলছে নীরবে নিজের জপধ্যান, লোককল্যাণের জন্যও প্রার্থনা।

পরবর্তী কালে উদ্বোধনের বাড়িতে আমরা দেখেছি ভক্তদের জন্যও ঠাকুরের প্রসাদের ব্যবস্থা করা, অসুস্থ ভক্তের পথ্য, তাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তোলা এবং এই সব দায়িত্ব সামলে নিজের কাজে মনোনিবেশ। এত কাজ-দায়িত্ব একা হাতে সামলানো, আবার কখনও ভবতারিণী মন্দিরে পুজোর জন্য ফুল তুলে মালা গেঁথে পাঠানো। কিন্তু কাউকে টের পেতে দেননি এ সব। কলকাতার বিশিষ্ট ভক্তরা জয়রামবাটীতে গেলে ঘুরে ঘুরে চায়ের দুধ জোগাড় করেছেন— শাকসব্জিও। নিজের হাতে বাড়িঘর-সংলগ্ন পথঘাট পরিষ্কার করেছেন। শুধু নিজের পরিবার নয়, সবার জন্য নিরলস চিন্তা— প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দটুকু মাথায় রাখা— এত কিছু ভালবাসা ছাড়া কি হয়! শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পর রানি রাসমণির তহবিল থেকে আসা টাকা বন্ধ হয়ে যায়। চূড়ান্ত দারিদ্র। সারদা তাতেও অবিচল থেকেছেন।

প্রাত্যহিকতার এই বিষয়গুলি শুধু সত্য নয়, চিরন্তন সত্য। আর এই যে জীবনাভিজ্ঞতা তা সারদার আধ্যাত্মিক চেতনাকে ভক্ত-পার্ষদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন সহজেই। জাগতিক এই সংসার সম্পর্কে বলেছেন, “বাবা, সংসার মহা দঁক (পাঁক), দঁকে পড়লে ওঠা মুশকিল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু খাবি খান, মানুষ কোন ছার! তা এই জগৎসংসারে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার নিদান কী? নির্বাসনা প্রার্থনা করা, কারণ, ‘দেহে মায়া দেহাত্মবুদ্ধি, শেষে এটাকেও কাটাতে হবে। কিসের দেহ, মা, দেড় সের ছাই বই তো নয়’— তার আবার গরব কিসের?” যে সব সংস্কার আমাদের মনকে খর্ব করে, যে সঙ্কীর্ণ ধর্মবুদ্ধি আমাদের ভেদনীতি শিক্ষা দেয়, সারদা চিরদিন তাকে বর্জন করেছেন। স্বল্পান্তর তিনি থাকেন পরিচিত পরিমণ্ডলে, কিন্তু কেউ না কেউ তাঁকে খবরের কাগজ পড়ে শোনান নিয়মিত। পাশ্চাত্যের সঙ্গে সেই সময় নিয়ত সাংস্কৃতিক সংযোগ ঘটছে তাঁর। ভক্তদের ইংরেজি শিখতে বলেন। গভীর দার্শনিক প্রজ্ঞায় বোঝেন, জীবনে দুঃখ যেমন সত্য, দুঃখ না থাকাও তেমনই সত্য। তাই নির্ভার মনে বলতে পারেন, ‘চিরদিন কেউ দুঃখী থাকবে না।’ ঈশ্বরলাভ করে যারা মানুষকে দূরে ঠেলেছে, তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘ভগবান লাভ হলে কী হয়? দুটো কি শিং বেরোয়? সদসৎ বিচার আসে? জ্ঞানচৈতন্য হয়— ভাবে কথাবার্তা, ভাবে সব হয়।’ কী অমোঘ সত্য, কী অবলীলায় বলা কথাগুলি!

সারদা ‘রামকৃষ্ণগতপ্রাণা’, কিন্তু কখনও কখনও স্বামীর আপত্তি সত্ত্বেও অনেককে নিজের কাছে ঠাঁই দিয়েছিলেন। জীবনপথে যারা ভ্রষ্ট হয়েছে কোনও কারণে তাদের শরণাগতি এবং ভুল বুঝতে পারাকেই তিনি সম্মান করেছেন, সরিয়ে দেননি। কোনও চেষ্টা ছাড়াই বলতে পারেন, ‘আমি সতেরও মা, অসতেরও মা’; ‘আমার শরৎ (স্বামী সারদানন্দ)-ও যেমন ছেলে, এই আমজাদও (সেই সময় কুখ্যাত ডাকাত, পরে সারদার একনিষ্ঠ ভক্ত) তেমন ছেলে।’

ভালবাসার অফুরান উৎস সারদা, আর সেই ভালবাসা থেকেই মেয়েদের দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পারেননি। ডোমরমণীর ওপর তার স্বামীর অত্যাচারে সরব হয়েছেন। বাপের বাড়িতে (কালীমামার) ভাইয়ের ছেলেদের অল্পবয়সে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হয়েছেন। মেয়েদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না এলে যে এ দুর্দশা ঘুচবে না, আর তার জন্য যে লেখাপড়া শেখা জরুরি বুঝেই উত্তর কলকাতার অবিবাহিত মেয়েদের নিবেদিতা স্কুলে পাঠাতে বলেন। শুধু মেয়েদের নয়, সাধু-ব্রহ্মচারীদের ইংরেজি শিক্ষার জন্য তিনি মঠ-মিশনে শিক্ষক রাখার পরামর্শও দেন। জগৎজীবন সম্পর্কে কতখানি ওয়াকিবহাল হলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি স্থাপনের যে চোদ্দো শর্ত প্রেসিডেন্ট উইলসন দিয়েছিলেন, তা শুনে কেতাবি শিক্ষা বর্জিত সারদা মন্তব্য করেন, ‘ওঁরা যা বলেন সব মুখস্থ।... যদি অন্তঃস্থ হত, তা হলে কথা ছিল না।’ কী দূরদর্শিতা! অন্তঃস্থ যে নয়, তা তো দেখিয়ে দিয়েছে অল্প দিনের মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

সারদার সব কিছুর মূলে ছিল প্রজ্ঞা, ভালবাসা। তাই আজ যে মানসিক চাঞ্চল্য মানুষকে গ্রাস করেছে, তা থেকে যত কুৎসা-কুকর্মের-মিথ্যাচারের বেসাতি, তার নিরসনে বলেন, ‘মনও তো মত্ত হাতি, তাকে নিয়ন্ত্রণ করাই তো জীবনের ধর্ম।’

অন্য বিষয়গুলি:

Sarada Devi Ramakrishna
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy