অমিত শাহ প্রায়ই ঠাট্টার ছলে দলের নেতা-কর্মীদের বলেন, ‘আমরা কখনও কোনও সরকার ফেলার জন্য আন্দোলন করিনি।’ তাঁর মতে, জনসঙ্ঘ ও বিজেপিই একমাত্র দল, যারা শুধু দেশের ঐক্য ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আন্দোলন করেছে। শুধুমাত্র ভিন্ন রাজনৈতিক ভাষ্য খাড়া করার চেষ্টায় লাখো লাখো বিজেপিকর্মী আন্দোলন করেছেন। তাঁরা পথে নেমেছেন একটা অন্য মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে।
মোদী জমানার গত ছ’বছরে এই প্রথম বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের সেই ‘রাজনৈতিক মতাদর্শ’ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কড়া প্রশ্নের সম্মুখীন। গত ছ’বছরে এই প্রথম নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহকে নিজেদের কথাই বেমালুম গিলে ফেলতে হচ্ছে। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক বার নয়া নাগরিকত্ব আইন ও এনআরসি-র সম্পর্ক স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাংলা-সহ গোটা দেশে এনআরসি আসছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। অথচ তার পরে প্রধানমন্ত্রীকে জনসভায় বলতে হচ্ছে, এনআরসি-র বিষয়ে এখনও কোনও আলোচনাই হয়নি। অমিত শাহকে সেই সুরেই ঘাড় নাড়তে হচ্ছে।
এই প্রথম কিছুটা হলেও মোদী-শাহকে দিশাহারা দেখাচ্ছে। কারণ তাঁদের মতাদর্শ প্রশ্নের মুখে। সংখ্যালঘু তোষণের বিরুদ্ধে বিজেপি-সঙ্ঘের অবস্থান মতাদর্শগত। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাড়ানো মতাদর্শেরই অংশ। সর্বোপরি মুসলিম রাষ্ট্রের হিন্দুদের এ দেশে আশ্রয় দেওয়া সঙ্ঘের হিন্দুরাষ্ট্রের ভাবনারই প্রথম ধাপ। সেই ভাবনার বিরুদ্ধেই প্রশ্ন উঠেছে। আরও মুশকিল হয়েছে, বিরোধীদের থেকেও জোর গলায় সেই প্রশ্ন তুলেছেন পড়ুয়ারা। তরুণ প্রজন্ম। শহরের শিক্ষিত মানুষ। যাঁদের ভোটে ভর করেই নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসেছিলেন। এখন তাঁদেরই অভিযোগের আঙুল নয়া নাগরিকত্ব আইনের দিকে। মুসলিমদের সঙ্গে বৈষম্য করা হচ্ছে, অতএব এই আইন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনার বিরোধী— এই মোদ্দা কথাটা পড়ুয়ারা স্পষ্ট করে বলছেন। এনআরসি হলে ‘হম কাগজ নেহি দিখায়েঙ্গে’ বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন। তাঁদের আঙুল বস্তুত সঙ্ঘের মতাদর্শের দিকে। তাঁরাও সরকার ফেলার কথা বলছেন না।
এমন নয় মোদী সরকার এই প্রথম বিজেপি-সঙ্ঘের মতাদর্শ মেনে কাজ করছে। তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দেওয়া জাত-ধর্ম নির্বিশেষে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করারই প্রথম ধাপ ছিল। প্রশ্ন উঠলে মোদী মুসলিম মহিলাদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। মুসলিম সমাজের মধ্যেই কার্যত বিভাজন করে দিয়ে কট্টরপন্থী মুসলিম পুরুষদের বিরুদ্ধে তিনি মুসলিম মহিলাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফিরে সঙ্ঘের মতাদর্শ মেনেই মোদী-শাহের প্রথম পদক্ষেপ ছিল, কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদ রদ করা। সমালোচনা হলে অমিত শাহ প্রশ্ন ছুড়েছেন, আপনারা কাশ্মীরকে ভারতের অখণ্ড অঙ্গ মনে করেন, না করেন না?
এখানেই মোদী-শাহ বিরোধীদের থেকে বরাবর এক কদম এগিয়ে ছিলেন। লোকসভা ভোট হোক বা রাজ্যের ভোট, রাজনৈতিক তরজার বিষয় বা ‘আজেন্ডা’ তাঁরা নিজেরা ঠিক করেছেন। উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে তিন তালাক, সার্জিকাল স্ট্রাইককে রাজনৈতিক ইসু করে তোলা বিজেপিরই কৌশল ছিল। লোকসভা ভোটের আগে মোদী জমানায় বেকারত্ব ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, চাষিরা ফসলের দাম পাচ্ছেন না বলে যখন বিতর্ক তুঙ্গে, তখন পুলওয়ামায় আধাসেনা কনভয়ে হামলার জবাবে বায়ুসেনা বালাকোটে পাক জঙ্গি শিবিরে হানা দেয়। পাকিস্তানের ঘরে ঢুকে মারাকেই প্রধান হাতিয়ার করে তোলেন মোদী-শাহ। নতুন করে ক্ষমতায় ফেরার পরেও অর্থনীতির দুরবস্থা পিছু ছাড়েনি। বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশে নেমেছে। তখন ৩৭০ রদ করার পথে এগিয়ে মোদী-শাহ বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। সার্জিকাল স্ট্রাইক বা বালাকোট বা ৩৭০, দিনের শেষে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই এর পুরোপুরি বিরোধিতা করা সম্ভব হয়নি।
এ বার ছবিটা উল্টো। এ বার মোদী-শাহ নয়া নাগরিকত্ব আইন নিয়ে এসেছেন। সেই আইন এবং তার দোসর হিসেবে এনআরসি-এনপিআর প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এনআরসি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় মোদী-শাহকে বলতে হচ্ছে, এনআরসি তো নেই। তা হলে এনআরসি নিয়ে আলোচনা কিসের! সিএএ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বিজেপি নেতারা বলছেন, আমরা কি নিপীড়িত হিন্দু-শিখদের এ দেশে আশ্রয় দেব না? কংগ্রেস-সহ বিরোধীরা কেন এর বিরোধিতা করছে? বাস্তব হল, বিরোধী বা পড়ুয়ারা এ প্রশ্ন তোলেননি। আসল প্রশ্ন থেকে বিজেপি নেতৃত্বকে কার্যত পালাতে হচ্ছে। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রশ্নের মুখে ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীকে এগিয়ে দিতে হচ্ছে। কখনও পুলিশ, কখনও গেরুয়া বাহিনী। মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত সমাজ তাতে আরও চটে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নির্দিষ্ট নেতৃত্বহীন এই ক্যাম্পাস-আন্দোলনের রাজনৈতিক মোকাবিলা করতে গিয়ে কার্যত হিমশিম খাচ্ছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
এত দিন কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের কথা বলতেন নরেন্দ্র মোদী। এখন চাপের মুখে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ বিরোধী রাজনীতির মুখ হিসেবে সেই কংগ্রেসকেই চাইছেন। বরাবর ‘রাহুলবাবা’ বলে কটাক্ষে অভ্যস্ত অমিত শাহ এখন বার বার ‘রাহুল গাঁধী’-কে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন, হিংসার জন্য দোষারোপ করছেন। নরেন্দ্র মোদী ‘কংগ্রেস, তার সঙ্গী দল ও তাদের ইকোসিস্টেম’-কে দায়ী করছেন। কংগ্রেসের হাতে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের নেতৃত্ব বা রাশ কোনওটাই নেই। কিন্তু মোদী-শাহ গোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব কংগ্রেসের কাঁধেই তুলে দিতে পারলে বাঁচেন। কারণ একটাই। উল্টো দিকে কংগ্রেস বা অন্য যে কোনও রাজনৈতিক দল থাকলে তার মোকাবিলা করা সহজ। কংগ্রেসকে ‘গত সত্তর বছরে কী করেছিলে’ বলে প্রশ্ন করা যায়! জওহরলাল নেহরু, যাদবপুর, আলিগড় বা জামিয়ার ছাত্রছাত্রীদের সে প্রশ্ন করা যায় না। আঞ্চলিক দলগুলো সরব বলেই তাদের বিরুদ্ধে সিবিআই-ইডি সক্রিয় হতে পারে। এমন নয় এই কৌশল বিজেপি নেয়, কংগ্রেসও ক্ষমতায় থাকতে একই কৌশল নিত। কিন্তু পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে সে কৌশলও খাটে না।
লোকসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও এখনও রাজ্যসভায় মোদী সরকারের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। যখনই সরকার রাজ্যসভায় বাধার মুখে পড়েছে, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মানুষের ভোটে জিতে আসা সরকারের কাজে বিরোধীরা বাধা দিচ্ছে। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনীতে লোকসভার সঙ্গে রাজ্যসভাতেও সংখ্যার অভাব হয়নি। কিন্তু সংসদে বিল পাশ হওয়ার পরে এখন মানুষকে বোঝাতে হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী গুজরাতের বিধানসভা ভোটের মতো পাকিস্তান-তাস খেললেও কাজ হচ্ছে না। অমিত শাহ থেকে বিজেপির নেতা-মন্ত্রীদের এখন নয়া নাগরিকত্ব আইনে কারও নাগরিকত্ব যাবে না, এনআরসি-র প্রসঙ্গ এখনও নেই বোঝাতে লোকের বাড়ি বাড়ি যেতে হচ্ছে। এত দিন যা বলেছেন, তার উল্টো কথা বিশ্বাস করাতে
গোটা দেশে প্রচার অভিযান করতে হচ্ছে। গত ছ’বছরে এই প্রথম।
‘অমিত শাহ অ্যান্ড দ্য মার্চ অব বিজেপি’ বইতে বিজেপির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায় ও গবেষক শিবানন্দ দ্বিবেদী লিখেছেন, দলের সভাপতি অমিত শাহ বিজেপির আন্দোলনের যাবতীয় নথি ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের উপরে জোর দেন। তাঁর নির্দেশে রাম জন্মভূমি আন্দোলন ও তাতে বিজেপির ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন নথি, গবেষকদের বই, নিবন্ধ বিজেপির লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে। ১৯৯৩-র এপ্রিলে প্রকাশিত বিজেপির ‘হোয়াইট পেপার অন অযোধ্যা অ্যান্ড দ্য রাম টেম্পল মুভমেন্ট’ খুঁজে বার করে, ধুলো ঝেড়ে ডিজিটাইজ় করা হয়েছে। অমিত শাহের নির্দেশেই।
নাগরিকত্ব আইন বা এনআরসি নিয়ে যে এতখানি ছাত্রসমাজের বিরোধিতার মুখে পড়তে হবে, তা আঁচ করতে পারেননি নরেন্দ্র মোদী বা অমিত শাহ। নিজের মতাদর্শে অনড় থেকে এই বিরোধিতা কাটিয়ে উঠতে তাঁরা কী কৌশল নেন, তা সফল হয় কি না, ভবিষ্যতের জন্য তার বিবরণও বিজেপির লাইব্রেরিতে নিশ্চয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নেবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy