গণতন্ত্র, তোমার মন নাই! আছে শুধু গরিষ্ঠের বলদর্পী আস্ফালন? বিরুদ্ধ স্বরের টুঁটি চেপে ধরে অন্তরালে চালান করার নিরন্তর প্রয়াস? তা না হলে বিরুদ্ধ স্বর দমিয়ে রাখার এই মরিয়া প্রয়াস কেন শাসক দলের? ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় যে সব বিদ্বজ্জন, মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, অধ্যাপক, কবিকে জেলবন্দি করা হয়েছে, এক বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁরা জামিন পেলেন না। জামিন পাওয়ার জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
মহারাষ্ট্রের পুণের কাছে ভীমা-কোরেগাঁওয়ে ২০১৮-র ১ জানুয়ারি দলিতদের সঙ্গে কট্টরবাদী মরাঠি সংগঠনগুলির তীব্র সংঘর্ষ বাধে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মৃত্যু হয় এক দলিত যুবকের। সেই ঘটনার পাঁচ মাস পরে গত বছরের ৬ জুন দিল্লি ও মুম্বই পুলিশের সঙ্গে যৌথ ভাবে পুণে পুলিশ নানা জায়গায় অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে পাঁচ সমাজকর্মীকে। জাতপাতের রক্তক্ষয়ী হিংসায় নাকি মদত দিয়েছেন দলিত ও জনজাতীয়দের হয়ে আইনি লড়াই লড়া আইনজীবী সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান বঙ্গতনয়া সোমা সেন, মহারাষ্ট্রে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক আন্দোলনের অগ্রণী দলিত কর্মী সুধীর ধাওয়ালে, দিল্লির জেএনইউ-তে পড়ার সময় থেকেই সামাজিক আন্দোলনে যুক্ত কর্মী রোনা উইলসন। এই তালিকায় আছেন মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর ছাত্র মহেশ রাউতও। প্রাইম মিনিস্টার রুরাল ডেভেলপমেন্ট-এর ফেলোশিপ পেয়েছেন তিনি। জনজাতীয়দের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে তিনি অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছেন বার বার।
অগস্টে গ্রেফতার হন আরও কয়েক জন মানবাধিকার কর্মী। আইনজীবী অরুণ ফেরেরা, আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজ, লেখক-কবি ভারাভারা রাও এবং শিক্ষাবিদ-সমাজকর্মী ভার্নন গঞ্জালভেস। মানবাধিকার কর্মী ও প্রাবন্ধিক গৌতম নওলাখার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও আদালতের নির্দেশে তাঁকে নিজেদের হেফাজতে পায়নি পুলিশ। তাঁকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। গৌতম বর্তমানে অন্তর্বর্তী জামিনে মুক্ত আছেন।
প্রাথমিক ভাবে যা ছিল ভীমা কোরেগাঁওয়ের হিংসাত্মক ঘটনায় মদত দেওয়ায় সীমাবদ্ধ, পরে তা পল্লবিত হয় পুলিশি ভাষ্যে। নভেম্বরে প্রথম চার্জশিটে জানানো হয়, ধৃতেরা নিষিদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত। যে দিন ভীমা-কোরেগাঁওয়ে তীব্র সংঘর্ষ বাধে, তার আগের দিন, ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর সেখানে ‘এলগার পরিষদ’ সংগঠিত করার পিছনে তাঁদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। সে দিন অভিযুক্তেরা সেখানে ‘প্ররোচনামূলক’ ভাষণ দেন।
অথচ, এই এলগার পরিষদের মূল উদ্যোক্তা দুই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বি জি কোলসে পাটিল এবং পি বি সবন্ত জানিয়েছেন, তাঁদের এই উদ্যোগের পিছনে মাওবাদীদের কোনও ভূমিকাই নেই এবং যাঁদের কথা পুলিশ বলছে, সেই সমাজকর্মীদের অধিকাংশকে তাঁরা আগে চিনতেনই না, তাঁদের ‘প্ররোচনামূলক’ ভাষণ দেওয়ার কথা তো দূর অস্ত্। পুলিশের দাবি, মাওবাদীরা বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজকর্মের প্রচারের জন্য এলগার পরিষদকে ব্যবহার করে। কিন্তু বম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পাটিল ও সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি সবন্ত জানাচ্ছেন, তাঁদের উদ্দেশ্য, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দেওয়া।
পুলিশ আদালতে জানায়, এই সমাজকর্মীদের গ্রেফতারের পরে শহরাঞ্চলে মাওবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জানা গিয়েছে। মাওবাদীরা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, ধৃতেরা সেই চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত। অভিযুক্তদের আইনজীবীদের বক্তব্য, এই ্অভিযোগ ভিত্তিহীন।
আশ্চর্য, ধৃতদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনলেও সে কথা কিন্তু পুলিশের এফআইআর-এ ছিল না। এমনকি, এই সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর রায়েও উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত কোনও এফআইআর পুলিশ করেনি। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য— ওই সমাজকর্মীদের গ্রেফতারের পরে মহারাষ্ট্রের পুলিশ প্রধান দু’-দু’টি সাংবাদিক সম্মেলনে মাওবাদী ষড়যন্ত্রের ‘অকাট্য প্রমাণ’ হিসেবে ১৩টি চিঠি পেশ করেছিলেন। জানাতে চেয়েছিলেন, ‘শহুরে নকশালরা’ কী ভাবে রিমোট কন্ট্রোলে মাওবাদী কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু সেই পুলিশই সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় কেন্দ্র বা মহারাষ্ট্র সরকারের হয়ে সেগুলি পেশ করেনি। এমনকি, ‘ট্রানজ়িট রিমান্ড’-এ অভিযুক্তদের নেওয়ার সময় নিম্ন আদালতেও এত ‘গুরুত্বপূর্ণ’ চিঠিগুলি জমা দেয়নি পুলিশ। অভিযুক্তদের দাবি, চিঠিগুলি ভুয়ো।
ধৃতদের আইনজীবী ও আত্মীয়দের অভিযোগ, নানা বাহানায় পুলিশ জেলবন্দিদের আদালতে পেশ করার ব্যাপারে গড়িমসি করে চলেছে। গ্যাডলিং-এর স্ত্রী জানিয়েছেন, গ্যাডলিং উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্রোগে ভুগছেন, কিন্তু মেডিক্যাল রিপোর্ট বাড়ির লোককে দেওয়া হচ্ছে না। বাতের ব্যথায় অসুস্থ সোমা সেন। কিন্তু বার বার আবেদন করা সত্ত্বেও জেলে তাঁর চেয়ার মেলেনি। বাধ্য হয়ে মেঝেতেই তাঁকে বসতে হত। বছরখানেক লড়াইয়ের পরে সদ্য চেয়ার পেয়েছেন তিনি। মহেশ রাউত কোলাইটিসে ভুগছেন। তাঁকে আয়ুর্বেদিক ওষুধ খাওয়ানোর কথা বললেও বাড়ির লোকের আনা সেই ওষুধ তাঁকে দিতে দেওয়া হচ্ছে না। অশীতিপর ভারাভারা রাও-ও খুব অসুস্থ। এঁদের কারও জামিন মেলেনি। নানা মামলায় জড়ানো হয়েছে তাঁদের। অর্থাৎ, কোনও মামলায় যদি তাঁদের কারও জামিন হয়, অন্য একটি মামলায় তিনি জামিন পাচ্ছেন না। এই ভাবে কারাবাসের মেয়াদ বেড়ে চলেছে।
পুলিশ প্রশাসনের এ খেলা নতুন নয়। যেমন নতুন নয় বিরুদ্ধ স্বরকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার ‘গণতান্ত্রিক’ খেলা। আর বিচারের বাণী? সে তো আছে নীরবে নিভৃতে কাঁদার জন্যই!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy