Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
গণতন্ত্র একটা পরীক্ষার খাতা
The Great Mosque of Ayasofya

রাষ্ট্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির হাতে যখন অধিকার সুরক্ষিত নয়

অনেক দিন ধরে সে দেশের রক্ষণশীল মুসলিমরা চেয়ে আসছেন এই ভোলবদল।

নবরূপে: ঐতিহাসিক সৌধকে মসজিদ ঘোষণার পর তার সামনে মানুষের উল্লাস প্রদর্শন, ইস্তানবুল, ১০ জুলাই। এএফপি

নবরূপে: ঐতিহাসিক সৌধকে মসজিদ ঘোষণার পর তার সামনে মানুষের উল্লাস প্রদর্শন, ইস্তানবুল, ১০ জুলাই। এএফপি

সেমন্তী ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

আয়া সোফিয়া নামে তুরস্কের ঐতিহাসিক সৌধ এখন থেকে মসজিদ হয়ে গেল। ডিক্রি পাশ করলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেজেপ তাইপ এর্দোয়ান, গত শুক্রবার। আর তার পর পরই সে দেশের আদালত তাঁর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানাল। ১৯৩৪ সালে মুস্তাফা কামাল আতাতুর্কের সৌজন্যে ধর্মমিলনের মিউজ়িয়াম তা হলে সক্রিয় মসজিদ হিসেবে এ বার সে দেশের ধর্মমন্ত্রকের আওতায়।

বিরাট পরিবর্তন। কিন্তু অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন বলা যায় কি? একেবারেই নয়। অনেক দিন ধরে সে দেশের রক্ষণশীল মুসলিমরা চেয়ে আসছেন এই ভোলবদল। দাবি করছেন, মাঝখানের ইতিহাস মুছে দিয়ে এই সৌধ আবার মসজিদ হয়ে যাক। এর্দোয়ান নিজে লাগাতার বলে এসেছেন, এ তাঁর মনের একান্ত ইচ্ছে, তাঁর প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে একটা।

স্বাভাবিক। সব দেশেরই কিছু প্রতীক থাকে। গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কের প্রতীক ছিল এই মনুমেন্ট। সেই প্রতীক ধ্বংস করলে তার টানে দেশের চরিত্রটাই বদলে দেওয়া যাবে! ওই শুক্রবারই, তুরস্কের ভুবনজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুক তাই সর্বসমক্ষে বললেন, না, তাঁর দেশ আর ধর্মনিরপেক্ষ নয়। শুক্রবার সেখান থেকে যখন প্রচারিত হল নমাজের ডাক, ‘নতুন মসজিদ’-এর সামনে গোটা চত্বর তখন ফেটে পড়ছে জনতার উল্লাসে, ‘আল্লাহ-উ-আকবর’ বিজয়োচ্ছ্বাসে। কিছু কাল আগেই বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তূপের উপর রামমন্দির তৈরি হবে— সর্বোচ্চ আদালতের এই রায় শুনে যেমন এশিয়ার আর এক ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র মাতোয়ারা হয়েছিল ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে, ঠিক তেমনই।

গণতান্ত্রিক দেশ তুরস্ক। প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান জননির্বাচিত হয়েই এসেছেন। তিনি এবং দেশের পার্লামেন্টে তাঁর দলের নির্বাচিত সঙ্গীরা সে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ কথাটার অর্থ অবশ্য এক এক দেশে এক এক রকম। ভারতে রামমন্দিরবাদীরা যে অর্থে ওজনদার, মোদীভক্তরা যেমন সর্বত্র-বিহারী, সর্বব্যাপ্ত, তুরস্কে কট্টর ইসলামিরা ঠিক অতটা ‘সংখ্যাগুরু’ নন। লম্বা সময় ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য বহন করে সে দেশের একটা বেশ বড় অংশ ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী হয়েছে, আর কট্টরদের পাশাপাশি থাকার ফলে নিজেদের মধ্যে এক রকম সাহস ও প্রত্যয়ও অর্জন করেছে, যেটা সব দেশে দেখা যায় না। তবুও ভোটের ফলাফলে, ইসলামি কট্টরবাদী নেতা এর্দোয়ান জয়ী। জয়ী বলেই শাসক। শাসক বলেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। শাসকের সিদ্ধান্ত বিরাট সংখ্যক বিরোধীরও না মেনে উপায় নেই। সুতরাং যদি কিছু মানুষের অধিকার কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও হয়, তাও বলতেই হবে সিদ্ধান্তটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নেওয়া।

কেবল পার্লামেন্ট কেন, গণতান্ত্রিক দেশের বিচারবিভাগের মধ্যেও গণতন্ত্রের পরোক্ষ প্রতিফলন থাকে, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের আদালতের সঙ্গে তার বেশ কিছু পার্থক্য থাকে। জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বা মনোনীত না হলেও— ধরে নেওয়া হয়— গণতান্ত্রিক দেশের আদালতের প্রধান দায়বোধ থাকে জনগণের কাছে, শাসকের কাছে নয়। ফলত যে গণতান্ত্রিক দেশে জনপ্রতিনিধি আর আদালতের মতামত, আদেশ, নির্দেশ একই সুরে ধ্বনিত হয়, তা দেশের ভিতরে বা বাইরে বিরোধীদের কাছে যত বিরক্তিকর, আপত্তিকর, বিপজ্জনক বলে মনে হোক না কেন— কিছুই বলার থাকে না। বরঞ্চ যত বিরোধিতা হয়, আপত্তি ওঠে, দেশের জাতীয়তাবাদী সরকার তাতে নিজেকে আরও শক্তিশালী হিসেবেই দেখে। নানা বাধা পেরিয়ে ‘মানুষের মত’কে রূপ দিতেই তো তারা এসেছে। তুরস্কের ঘটনা শুনে গ্রিস, রাশিয়া, আমেরিকার মতো দেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝড় উঠতে দেখে প্রেসিডেন্ট এর্দোয়ান তাই সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন— বলো ভাই যে যা বলতে চাও, ‘‘আমরা কখনওই তোমাদের সমর্থন কিংবা স্বীকৃতি চাইতে যাব না।’’ ‘‘ডু ইউ রুল টার্কি, অর ডু উই?’’

ফলে আজ কর্তৃত্ববাদ চাপানোর জন্য, দেশের চরিত্র পাল্টে তাকে রক্ষণশীল করার জন্য, মানুষের অধিকারচ্যুতির রাজনীতি করার জন্য খুব বেশি কিছু দরকার হয় না— ভোটে জেতা ছাড়া। আগেকার দিনে যা করা হত বড় মাপের রাজনৈতিক পালাবদল বা সামরিক অভ্যুত্থান দিয়ে, সত্তরের দশকে চিলিতে প্রেসিডেন্ট আয়েন্দেকে সরাতে যেমন সেনাবাহিনীর অভিযান দেখা গিয়েছিল, কিংবা ইরানে খোমেইনির কট্টর ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য লেগেছিল একটা গোটা রক্তক্ষয়ী বিপ্লব, সে সব এখন বস্তাপচা। গণতন্ত্রের দেশে আজ ধৈর্য ও প্রত্যয়ের সঙ্গে আস্তে আস্তে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ক্ষয় করিয়ে দেওয়া যায়। এবং তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যমেই ঘটানো যায়। কেবল একটা-দুটো দেশের কথা নয়, এ এখন বিশ্বদুনিয়ার বাস্তব। আয়া সোফিয়া মসজিদ শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়েই প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রাজিলেও নির্বাচিত নেতা প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের আদালতের বিচারেই নিতান্ত সুচারু ভাবে এক এক করে সরিয়ে দেওয়া হয়। সত্যি বলতে কি, আইনবিচার যে কী ভাবে এই নিয়োলিবারাল তন্ত্রকে জোরদার করছে, সে সব দেখেশুনে একটি নতুন শব্দই তৈরি হয়ে গিয়েছে, যার নাম (‘ওয়ারফেয়ার’ নয়) ‘লফেয়ার’: (যুদ্ধবিগ্রহ নয়), বিচারবিগ্রহ। ব্রাজিলের রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘‘লফেয়ার ইজ় দ্য নিউ অথরিটারিয়ানিজ়ম।’’

এই নতুন কর্তৃত্ববাদ নিয়ে আরও আলোচনা জরুরি। কিন্তু আপাতত বলি, আজকের গবেষক ও বিশ্লেষকরা এই বিশ্বব্যাপী বিকারের উপর যে নতুন আলো ফেলছেন, তার থেকে ক্রমশই একটা সত্যের দিকে এগোনো সম্ভব।

গণতন্ত্র দিয়ে গণতন্ত্রকে মারার এই সমস্যা আজ হঠাৎ করে চার দিক জুড়ে চোখ ধাঁধানো হয়ে উঠলেও ঘটনাটা নতুন নয়।। সম্ভবত এ হল গণতন্ত্রের একেবারে গোড়ার সমস্যা। মেজরিটারিয়ানিজ়ম বা সংখ্যাগুরুবাদ বলতে আমরা আজ যা বুঝি, সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষা করার কর্তব্য যে সংখ্যাগুরু মানুষেরই তা আজ যে ভাবে আমরা ভুলে যাই, গণতন্ত্রের প্রারম্ভিক চিন্তার মধ্যেই সেই আক্রমণাত্মক প্রবণতায় চলে যাওয়ার ঝুঁকিটা হয়তো গোড়া থেকেই ছিল। এমনকি, আজকের পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যখন আমরা গণতন্ত্র-তত্ত্বের অন্যতম পুরোধা জন স্টুয়ার্ট মিলের ‘রিপ্রেজ়েন্টেটিভ গভর্নমেন্ট’ পড়তে বসি, তখনও হয়তো খুঁজে পাই তার মধ্যেকার ভয়ের গর্তগুলো। মিল বলেছিলেন যে, হয় গোটা সমাজ, নয়তো সমাজের এক বড় অংশ ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধিদের ‘পূর্ণ ক্ষমতা’ দেবে। তাঁর সেই কথায় কি ক্ষমতার সামগ্রিকতার উপর বেশ বড় রকমের জোর ছিল না? ক্ষমতা— ‘‘দে মাস্ট পজ়েজ় ইন অল কমপ্লিটনেস’’, বলেছিলেন তিনি। ক্ষমতার পিছনে কেবল চাই মানুষের স্বীকৃতি। কিন্তু কী রকম স্বীকৃতি, কোন পথে? মিলের মতোই মার্কিন রাষ্ট্রদার্শনিক জেফারসনও শাসকের প্রতি শাসিতের যে ‘কনসেন্ট’ বা স্বীকৃতির কথা বলেছিলেন, তারও কি প্রধান রূপ ভোটের ছাপ নয়? স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতির অন্যান্য পথ যে ভোটের হিসেবের তলায় কবর দেওয়া যায়, গত কয়েক দশকের ইতিহাস তা প্রমাণ করে দিয়েছে। দিয়েছে বলেই আজ তার এই প্রবল দাপট, প্রচণ্ড রূপ।

আসলে গণতন্ত্রের মধ্যে মানুষের মতপ্রকাশের অধিকারের স্বীকৃতি আছে, এবং তার ভিত্তিতে শাসনেরও একটি স্বীকৃতির শর্ত আছে, এ সবই ঠিক। কিন্তু গণতন্ত্র বলতে আমরা আরও যা যা ভাবি, যে সর্বজনীনতা, সাম্য, বৈষম্যহীনতার কথা ভাবি— সেটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি। ওগুলি গণতন্ত্রের ‘চরিত্র’ নয়, গণতন্ত্রের ‘লক্ষ্য’। সকলের মতাধিকার অভ্যেস করতে করতে এখানে এক দিন আমাদের সাম্যে পৌঁছনো সম্ভব— তাই সাম্য গণতন্ত্রের লক্ষ্য। কিন্তু তার অর্থ কি এই যে গণতন্ত্রের ঘোষণা মানেই সেই সাম্যের লক্ষ্য পূর্ণ হয়ে যাওয়া? এখানে লক্ষ্য আর পথকে গুলিয়ে ফেলার একটা বিপদ পরিষ্কার। সমাজ-দার্শনিক চার্লস টেলর বলেছেন, গণতন্ত্রের মধ্যে ‘টেলস’ (telos: ভবিষ্যতে যা ঘটবে, সেটাকেই অতীতের কাজকর্মের উদ্দেশ্য হিসেবে ভেবে ফেলা) এনে ভুল বিচার করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। অথচ ঘটনা হল, গণতন্ত্র তার কাঙ্ক্ষিত সাফল্যে পৌঁছবে কি না, তা নির্ভর করছে আমরা কী ভাবে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করব, তার উপরেই।

সে দিক থেকে, গণতন্ত্র একটা পরীক্ষার খাতা। আমরা তাতে কী লিখব, আমরাই তা ঠিক করব।

আপাতত আমরা ঠিক করেছি, আমাদের থেকে যারা কম— ক্ষমতায় কম, প্রভাবে কম, সম্পদে কম, সবচেয়ে বড় কথা, সংখ্যায় কম, তাদের এক হাত নিয়েই ছাড়ব। আমাদেরই নেতাদের উপর সেই শাসন আর বিচারের ভার দেব, ক্রমশ, পায়ে পায়ে, কাজ সারার। তুরস্কেও। অন্য দেশেও।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy