বছরটা শেষ হতে পারত এক চূড়ান্ত ‘ডিসটোপিয়া’য়— দুষ্কল্পরাজ্যে— যেখানে এক দুর্দান্ত শাসক আর তার দুষ্ট পার্শ্বচর ধ্বংস করে দেন সত্তর বছর ধরে গড়ে তোলা গণতন্ত্রের কাঠামোখানা। তার বদলে, বছরটা শেষ হচ্ছে আশ্চর্য সব সংহতির সম্ভাবনা তৈরি করে— যেখানে ছাত্রদের সঙ্গে সংহতি গড়ে ওঠে কৃষিজীবী মানুষের, বোরখা পরে মিছিলে আসেন ইন্দুলেখা নাম্নী হিন্দু তরুণী, জামা মসজিদ থেকে দেশের সংবিধান হাতে পুরনো দিল্লির রাস্তায় নামেন জঙ্গি দলিত নেতা, পুলিশকে ঘিরে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গায় বাচ্চা ছেলেমেয়েরা। বছর শেষ হচ্ছে একটা আশাবাদে— ভারত নামের ধারণাটাকে গলা টিপে মেরে ফেলা অত সহজ নয়।
ঠিক এই বিশ্বাসটাই হারিয়ে যেতে বসেছিল। অগস্ট মাসের পাঁচ তারিখ যখন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করল সরকার, বা সে মাসেরই শেষে অসমের নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদ পড়ল উনিশ লক্ষ ভারতীয়ের নাম, প্রতিবাদ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, লড়াইগুলো যেন বিচ্ছিন্ন সব যুদ্ধ ছিল— যেখানে যার লড়াই, সে সেটুকু লড়ছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যে আসলে কারও একার নয়, সেই ময়দানে হাতে হাত ধরে, বেঁধে বেঁধে থেকে এগোতে হয়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে পৌঁছনোর আগে অবধি এই কথাটা যেন পায়ের নীচে জমি পাচ্ছিল না।
হয়তো সেটাই ভরসা দিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীদের। এ বছর তাঁদের মুসলমান-বিদ্বেষের রাজনীতি একটা নতুন মোড় নিল। এত দিন যা ছিল দলের, অথবা সঙ্ঘের, প্রকল্প— এ বছর সে বিদ্বেষকেই তাঁরা রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে পরিণত করলেন। রাষ্ট্রের মুখে বসিয়ে দিলেন হিন্দুত্ববাদী বয়ান। দিনের পর দিন কাশ্মীর উপত্যকা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকল। সেখানে ফোন চলে না, ইন্টারনেট নেই। স্কুল খোলে না, বাজার বসে না। রাজ্যের সব প্রথম সারির নেতা (গৃহ)বন্দি হলেন। কার্ফু নিয়ম হয়ে গেল। কাশ্মীরের মুসলমান মানুষকে এমন বিপন্ন করে তোলার রাজনৈতিক অঙ্গীকার বিজেপির দীর্ঘ দিনের। কিন্তু, সত্যিই যখন মোদী-শাহ জুটি রাষ্ট্রকে দিয়ে সেই কাজ করিয়ে নিলেন, তেমন প্রতিবাদ শোনা গেল না কোথাও। যাঁরা ডাল লেকের ধারে বাড়ি কেনার, অথবা কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করার নির্বোধ রসিকতা থেকে দূরে থাকলেন, তাঁরাও খুব জোর গলায় বললেন না যে কাশ্মীরে যা হয়েছে, তা ঘোর অন্যায়। তা বিশ্বাসভঙ্গ। ভারত নামক রাষ্ট্র স্বাধীনতা-পরবর্তী চুক্তি ভেঙে এই আচরণ করতে পারে না। গোটা দেশ যেন মেনে নিল, রাষ্ট্র অতঃপর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির হাত ধরে চলবে।
সেই মেনে নেওয়ার জোরেই হয়তো, অসমে এনআরসি-র তালিকা প্রকাশের পরও, মুসলমানদের পাশাপাশি বারো লক্ষ হিন্দুর নাগরিকত্বের দাবি নাকচ হয়ে যাওয়ার পরও অমিত শাহেরা বললেন, গোটা দেশ জুড়ে এনআরসি হবে। কেন, সেই প্রশ্নটা শোনা গেল না তেমন। এনআরসি যে কোনও স্বাভাবিক ব্যবস্থা নয়, অসম চুক্তির সূত্র ধরে এই বিশেষ ব্যবস্থাটির কথা এসেছে এবং এনআরসি হলে শুধুমাত্র সেই রাজ্যেই হওয়ার কথা, অমিত শাহদের গলার জোরে সে সব ইতিহাস হারিয়েই গেল। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব যে ভারত নামক ধারণাটির একেবারে আগাগোড়া বিরোধী, সংসদে সংখ্যার জোরে সেই কথাটাকে চেপে দিতে থাকলেন অমিত শাহেরা। সত্যি বলতে, নয়া নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার আগে অবধি তাঁদের সেই গা-জোয়ারি তেমন প্রতিরোধের মুখেও পড়েনি।
বরং, ক্রমশ বোঝা গেল, শুধু বিজেপি-আরএসএস’এর রাজনৈতিক বয়ানেই নয়, রাষ্ট্র হিসেবেই ভারত এ বার হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে উঠছে। মুসলমানেরা বুঝলেন, এ দেশে তাঁরা সত্যিই দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তার মোক্ষম প্রমাণ মিলল নভেম্বর মাসে। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জানাল, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে রাম মন্দিরই হবে— কারণ, বিপুলসংখ্যক হিন্দু বিশ্বাস করেন যে মসজিদের জমিতেই রাম জন্মভূমি— কার্যত নিঃশব্দে সেই রায় শিরোধার্য করলেন ভারতীয় মুসলমানেরা। মহামান্য আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ায় ভরসা রাখতেই হবে, তবে এটাও কি তাৎপর্যপূর্ণ নয় যে আদালতের রায় নিয়ে সংবিধানবিশেষজ্ঞরাই যেখানে বহু প্রশ্ন তুললেন, মুসলমান সমাজ কিন্তু টুঁ শব্দটিও করল না?
অবশ্য, শুধু হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, দুষ্কল্পরাজ্যের সব চরিত্রলক্ষণই ফুটে উঠছিল ভারতের গায়ে। সামরিক বাহিনী ক্রমে রাজনীতির অঙ্গ হয়ে উঠল— এমন ভাবে যে বিপিন রাওয়ত নাগরিকত্ব বিল-বিরোধী আন্দোলনের ন্যায্যতা নিয়েও নিজের মত প্রকাশ করলেন, সামান্য ধোঁকার টাটি খাড়া করেই। তার মাসখানেক আগে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুলিশ লেলিয়ে দিল সরকার। পিটিয়ে শায়েস্তা করল আলিগড়, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার ছাত্রদের। চার দিকে এমনই ভয়ের পরিবেশ তৈরি করল যে রাহুল বজাজের মতো প্রথম সারির শিল্পপতিও রেহাই পেলেন না আক্রমণের হাত থেকে। যে পরিসংখ্যানে ধরা পড়ল যে মানুষ আর্থিক ভাবে আগের তুলনায় খারাপ আছে, সেই পরিসংখ্যান প্রকাশই করল না সরকার।
অনেকেই বলছেন, অর্থনীতির বিপর্যস্ত অবস্থাটাকে চেপে রাখার জন্যই এমন সার্বিক দমননীতি— এমনকি, নয়া নাগরিকত্ব আইন আর এনআরসি-র সর্বগ্রাসী আগুন নিয়ে এই ছেলেখেলা। এই জমানায় যে কোনও ষড়যন্ত্র তত্ত্বকেই সত্যি মনে হয়— কিন্তু, তলিয়ে দেখলে বোধ হয় আরও বড় এক ছক চোখে পড়বে। ২০১৯ সালের সবচেয়ে মারাত্মক ছক— গণতন্ত্রের ভেতর থেকেই স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সে শাসনে অর্থনীতির বিপাক চাপা দেওয়ার জন্য অন্য গোলমালের প্রয়োজন হয় না। সেখানে শাসকদের জোর এমনই যে কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করলেও চলে— কারণ, শাসকেরা জানেন, মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবেন সব। ভাববেন, হচ্ছে যখন, ভালর জন্যই হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের এই প্রশ্নহীন আনুগত্য, বিশ্বাসই স্বৈরনায়কদের সবচেয়ে বড় জোরের জায়গা। অস্বীকার করার উপায় নেই, লোকসভা নির্বাচনে জিতে ফেরার পর আমজনতার এই আনুগত্যই নরেন্দ্র মোদীদের সাহস জুগিয়েছিল স্বৈরতন্ত্রের পথে আরও এক পা ফেলার, ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণাটাকেই দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার। দেশে যখন গো-রক্ষার নামে মুসলমান-হত্যা হচ্ছিল, ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’-এর মোকাবিলার অছিলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছিল আধাসামরিক বাহিনী, যখন অর্থনীতির দোহাই দিয়ে বিপুল করছাড় দেওয়া হচ্ছিল কর্পোরেট সেক্টরকে, যখন অখণ্ড ভারতের স্লোগান তুলে শ্বাসরোধ করা হল কাশ্মীরের— সত্যিই দেশের সিংহভাগ মানুষ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিলেন সব কিছু। সেই সম্মতি, সেই আনুগত্য অমিত শাহদের সাহস দিয়েছিল দলীয় ইচ্ছাগুলোকে রাষ্ট্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার। গোলওয়ালকরের বেঁধে দেওয়া হিন্দুরাষ্ট্রের সুরে ভারতকে গান গাওয়ানোর।
তাঁদের বছরভরের দাপাদাপি, এক অন্যায় থেকে নির্দ্বিধায় অন্য অন্যায়ে ঝাঁপিয়ে পড়া যে ডিসেম্বরে ধাক্কা খাবে, মোদী-শাহ সম্ভবত সেই আশঙ্কা করেননি। যে দেশ হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় এত দিন বিনা প্রশ্নে সম্মতি জানাচ্ছিল, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে সেই দেশের পাহাড় থেকে সাগর এ ভাবে প্রতিবাদ করবে, সেটা বুঝতে পারেননি। সুর কি তবে নরম হবে এ বার? ভারতকে পাল্টে দেওয়ার এই প্রবল চেষ্টা কিছু স্তিমিত হবে কি? জানা নেই। তাই, না-পাল্টানোর লড়াইটাও চালিয়ে যেতে হবে।
২০২০ সালেও যে লড়াইটা চলবে, ক্ষমতাদর্পী শাসকেরা সহজে ওয়াকওভার পাবেন না— এই আশাটুকুই কি এমন অন্ধকার বছরের শেষে এসে কিছু কম পাওয়া?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy