Advertisement
E-Paper

আচার নয়, যৌথ যাপন

নরেন্দ্র দেবের প্রয়াণের পরে ক্রিয়াকর্ম করছেন কন্যা নবনীতা দেব সেন। পৌরোহিত্যে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করতেই অবাক নবনীতা: ‘এ যে গায়ত্রী, কাকাবাবু। আমি একেই অব্রাহ্মণ, তায় নারী।’

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২০ ০০:৩১
Share
Save

নরেন্দ্র দেবের প্রয়াণের পরে ক্রিয়াকর্ম করছেন কন্যা নবনীতা দেব সেন। পৌরোহিত্যে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করতেই অবাক নবনীতা: ‘এ যে গায়ত্রী, কাকাবাবু। আমি একেই অব্রাহ্মণ, তায় নারী।’ ধমক ভাষাচার্যের, ‘যে মানুষ বেদ উপনিষদ পড়েছে, মন্ত্রের মানে যে বোঝে, যার জীবনধর্ম হচ্ছে অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা— তাকে গায়ত্রী পড়াব না? পড়াতে হবে কোনও নিরক্ষর ভূতকে, যে ঘটনাচক্রে ব্রাহ্মণ-বংশে জন্মেছে?’

ঘটনা দুই: মালদহের হবিবপুরে স্কুলে সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে ছিলেন রোহিলা হেমব্রম।

নারীর পৌরোহিত্য নিয়ে তর্ক, বাধা, এমনকি ‘লিবারাল’ অভিনন্দন— হিন্দু-পরম্পরার নিরিখে এ সবই আসলে অপ্রাসঙ্গিক। কারণ, বিয়ের বহু মন্ত্রেরই রচয়িতা এক নারী, ঋষি সূর্যা। পাশাপাশি, স্মৃতিকার যমের সাক্ষ্য, ‘পুরাকল্পে কুমারীণাং মৌঞ্জীবন্ধনম্ ইষ্যতে/ অধ্যাপনং চ বেদানাং সাবিত্রীবচনং তথা।’ বেদ-পাঠের পাশাপাশি উপনয়নও হত নারীর।

আবার প্রচলিত দৃষ্টিতে বৈধব্য হিন্দু নারীর পালনীয় সংস্কার। কিন্তু বেদের যুগে স্ত্রীর মৃত্যু হলে যজ্ঞের অধিকার হারাতেন স্বামী। বৈধব্য স্বামী বা পুরুষেরও পালনীয় ‘সংস্কার’ যে! অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম গোড়া থেকেই সর্বাধিকারের পরিসর তৈরি করেছে।

এই বিষয়গুলি দিয়ে নান্দীপাঠের কারণ, হিন্দু-ধর্মের কাঠামো, ‘শাস্ত্র’ অস্বীকার করে প্রচলিত আচার, সংস্কারের বাঁধনকে। এই অস্বীকারের শক্তি নিহিত সর্বাধিকার দান, সর্ব-গ্রহণ ও সর্বায়ত, এই ত্রি-চেতনায়। এই চেতনা এক নয়, বহুর কথা বলে। সর্ব-গ্রহণ চেতনা তৈরি হয় অধ্যাত্ম বা সামাজিক কারণে। কখনও বা দু’টি কারণ একত্রে কাজ করে। বঙ্কিমচন্দ্র দেখিয়েছিলেন, ‘ঋগ্‌বেদ’-এর সময়ে আর্য-অনার্য সংমিশ্রণ ঘটেছিল (‘কৃষ্ণচরিত্র’)।

সম্প্রতি শিব-চিত্র কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে যুদ্ধ বাধে নেট-নাগরিকদের মধ্যে। অথচ শিবই সম্ভবত বঙ্কিম কথিত সংমিশ্রণেরই শ্রেষ্ঠ প্রতীক। আর্যদের আগমনের আগেই শিবের আরাধনা প্রচলিত ছিল ভারতে। রাম-রাবণের যুদ্ধ, কিরাতরূপী শিবের কাছে অর্জুনের হার প্রভৃতি ‘ঘটনা’ বা আখ্যানকে আর্য-অনার্য সংস্কৃতির সংঘাত হিসেবে দেখেন বহু তাত্ত্বিক। কিন্তু পাশাপাশি দু’টি জাতি থাকলে সম্বন্ধও অনিবার্য। অতএব আর্যের ঘরে গৃহিণীদের সূত্রে ঢুকে পড়লেন তাঁদের পিতৃকুলের আরাধ্য শিব (‘বামন পুরাণ’-এ আখ্যান রয়েছে এ নিয়ে)। শিব আর্যেরও দেব হলেন। তাঁর আর এক নাম হল রুদ্র। রুদ্র বৈদিক দেবতা। ‘ঋগ্‌বেদ’-এ শিব শব্দের (‘৭।১৮।৭’) উল্লেখ আছে, কিন্তু দেব নয়, জাতি অর্থে। ঋষি অরবিন্দের মতে, শব্দটির ব্যবহার ‘সদাশয়’, ‘শুভ’ প্রভৃতি অর্থে। শিব সৃষ্টির প্রতীক, রুদ্র ধ্বংসের। রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘ব্রহ্মায় আর্যসমাজের আরম্ভকাল, বিষ্ণুতে মধ্যাহ্নকাল এবং শিবে তাহার শেষ পরিণতির রূপ রহিল।’ (‘ইতিহাস’)

অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম বলতে আজকে আমরা যা দেখি, আসলে তার পরম্পরায় আশ্রিত বৃহত্তর সমাজ। এই পরম্পরাতেই বিস্তার সর্বায়ত চেতনার। আধুনিক ভারতের নানা প্রান্তে জাতের নামে বজ্জাতি, খুনোখুনির অভিযোগ সামনে এসেছে বারবার। শরীরের আকার-বর্ণ নিয়ে ব্যঙ্গ করার ঘৃণ্য প্রবৃত্তি পথে-নেটে দেখা যায়। মানসিক-হাসপাতাল ‘থিম’ হয় পুজোয়, মেলায়। কিন্তু ‘যজুর্বেদ’-এর যজ্ঞে দেখা যায়, মানসিক ভারসাম্যহীন, চণ্ডাল, মোটা, অতি-কৃষ্ণ গাত্রবর্ণ-সহ নানা ধরনের মানুষের উপস্থিতি। যৌথ-সমাজের এই ভাবনার জন্যই ‘মৈত্রেয় উপনিষদ’ তাই জানায়, ‘মানবদেহই যথার্থ দেবালয়।’ ধর্মের নামে সেই দেবালয় নিগ্রহ করে যে আচার, সেই সাধনা আদতে ভস্মে ঘি ঢালা। (‘ভাগবত’) মনে পড়ে ক্ষিতিমোহন সেনের মোক্ষম কথাটি, ‘এই-সব আচার বড়ো বড়ো পণ্ডিতদের মতামতে ততটা ধরা পড়ে না যত ধরা পড়ে প্রাকৃতজনের সংস্কার দেখিলে।’ (‘হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ’)

এই প্রাকৃতজনের সংস্কার, তার সাহিত্য-শিল্পের পরিসরটিকে হিন্দু ধর্মের ত্রি-চেতনার উদাহরণ হিসেবে পড়া যায়। গোড়ায় বলে রাখা ‘ভাল’, ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকের ভিন্‌ধর্মাবলম্বীদের উপর ‘অত্যাচার’-এর বহু নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু সেই শাসকই ভিন্‌ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন, এমন উদাহরণও রয়েছে। পাশাপাশি, জনের ভাবনায় শাসকের অধিকার যে সামান্যই, তা-ও দেখা যায়। তাই সপ্তদশ শতকের শেষে বাংলার পিরপাঁচালিতে বৌদ্ধ ধর্মঠাকুর, মুসলিম পির, হিন্দু নারায়ণের অপূর্ব সংমিশ্রণ দেখেন সুকুমার সেন। কবি ফৈজুল্লার সত্যপিরের পাঁচালিতে বলা হয়, ‘তুমি ব্রহ্মা, তুমি বিষ্ণু, তুমি নারায়ণ/ শুন গাজী আপনি আসরে দেহ মন।’ আবার পূর্ব ভারতে বহু হিন্দু কবি রাম ও রহিম, উভয়কে বন্দনা করে পাঁচালি লেখেন।

পাশাপাশি, আকবরের আমলে চার চিত্রশিল্পীর নাম জানান আবুল ফজল: জুদ্‌দী, খাজা আব্দুস সামাদ, যশোবন্ত এবাং বাশাওন। শেষোক্ত দু’জন ধর্মে হিন্দু। অর্থাৎ চিত্রশিল্পেও ‘সনাতনি’ ও ইসলামি শিল্প এবং শিল্পীর মেলবন্ধন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতের শিক্ষক হিসেবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী ফিরোজ খানের নাম সামনে আসতেই বিক্ষোভ হয়। অথচ, দরাফ খাঁ সংস্কৃতে রচনা করেছিলেন ‘গঙ্গাষ্টক’ বা গঙ্গাস্তোত্র! কিছু দিন আগে দিল্লিতে মুসলিম পড়শিদের বাঁচিয়ে নিজে দগ্ধ হয়েছিলেন প্রেমকান্ত বাঘেল। প্রেমকান্ত হিন্দু ধর্মের সারকথাটি বুঝেছেন স্ব-অভিজ্ঞতায়। কথাটি শান্তিপর্বে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকেও বুঝিয়েছিলেন: মানুষের থেকে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নয়।

Religion Hinduism Islam

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}