ছবি: সংগৃহীত
দারিদ্র কি বাড়িতেছে? গত বৎসর জাতীয় নমুনা সমীক্ষা বলিয়াছিল, বেকারত্ব বাড়িয়াছে। এ বার বলিল, ব্যয়ক্ষমতা কমিয়াছে। সংবাদে প্রকাশ, খাদ্য-বস্ত্র-সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্যের জন্য ২০১১-১২ সালে ভারতীয়রা মাথাপিছু খরচ করিয়াছিল ১৫০১ টাকা। ২০১৭-১৮ সালে সেই খরচ কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ১৪৪৬ টাকা। লক্ষণীয়, এই অঙ্কগুলি মূল্যস্ফীতির প্রভাব-মুক্ত প্রকৃত (রিয়াল) ব্যয়ের হিসাব— ২০০৯-১০ সালের মূল্যমান অনুসারে নির্ণীত। কেন্দ্র এই তথ্য মানিতে রাজি নহে, কিন্তু দেশবাসী উপেক্ষা করিতে পারিবে কি? প্রায় চার দশক পরে এই প্রথম মাথাপিছু মাসিক ব্যয় কমিল। মনে রাখা দরকার, সত্তরের দশকে প্রকৃত ব্যয়ের অনুরূপ হ্রাস ঘটে পেট্রোলিয়ামের ঐতিহাসিক মূল্যস্ফীতির ধাক্কায়, যে ঘটনা বিশ্ব জুড়িয়া অর্থনৈতিক সঙ্কট ডাকিয়া আনিয়াছিল। সংবাদে প্রকাশ, মাথাপিছু ব্যয় শহরাঞ্চলে আগের তুলনায় অতি সামান্য (দুই শতাংশ) বাড়িলেও অনেকখানি কমিয়াছে গ্রামাঞ্চলে (৮.৮ শতাংশ)। তাহার অর্থ, বহু গ্রামীণ পরিবার দৈনন্দিন প্রয়োজন মিটাইতে পূর্বের চাইতে অধিক চাপ অনুভব করিতেছে। আশ্চর্য নহে। গত কয়েক মাসে উত্তরোত্তর স্পষ্ট হইয়াছে যে, খরচ কমাইতে মানুষ চাহিদা কমাইতেছে। তাই বিস্কুট হইতে গাড়ি, সকল প্রকার পণ্যের উৎপাদন কমিয়াছে। উৎপাদক সংস্থাগুলি তালা ঝুলাইয়াছে একের পর এক কারখানায়। এই বার উপভোক্তাদের উপর সমীক্ষা করিয়া প্রাপ্ত তথ্যও সেই সত্যকেই প্রতিষ্ঠা করিল।
গ্রামীণ দরিদ্রের গলায় দারিদ্রের ফাঁস যে আরও চাপিয়া বসিতেছে, তাহার সাক্ষ্যও কম নাই। গত ছয়-সাত বৎসর কৃষকের আয় প্রায় কিছুই বাড়ে নাই। নীতি আয়োগের নথি বলিতেছে, ২০০৪-০৫ হইতে ২০১১-১২ সাল পর্যন্ত চাষির আয় গড়ে বছরে সাড়ে পাঁচ শতাংশ বাড়িয়াছিল। কিন্তু তাহার পর আয়বৃদ্ধির হার কমিয়া দাঁড়াইয়াছে বৎসরে গড়ে ১.৩ শতাংশ। অনেক বিশেষজ্ঞের দাবি, মূল্যস্ফীতির নিরিখে হিসাব করিলে বস্তুত চাষির আয় কমিয়াছে। কৃষকদের আন্দোলনে মহানগরগুলি উত্তাল হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের আর্থিক সুরক্ষার ব্যবস্থা হয় নাই। ঋণ মকুব, ফসলের সহায়কমূল্য কিংবা ফসলবিমা, সরকারের কোনও উদ্যোগই চাষির রোজগার সুরক্ষিত করিতে যথেষ্ট কার্যকর হয় নাই। কৃষিমজুর এবং অকৃষি-মজুরের অবস্থাও তথৈবচ। গত পাঁচ বৎসর তাহাদের মজুরিতে বাস্তবিক বৃদ্ধি হয় নাই। এই সকল কারণে গ্রামে মাথাপিছু ব্যয়ে এমন অভূতপূর্ব পতন। গ্রামীণ ভারত আজ অর্থনৈতিক সঙ্কটের কবলে। সরকারি নীতি এই সঙ্কটের মোকাবিলায় সামান্যই করিয়াছে। ২০০৬ সালে শুরু হইবার পর একশত দিনের কাজের প্রকল্প গ্রামীণ রোজগার বাড়াইতে অনেকটাই কার্যকর হইয়াছিল। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকার তাহার প্রতি অপ্রসন্ন। বরাদ্দ ছাঁটা হইয়াছে, রাজ্যে টাকা পাঠাইতে বিলম্ব হইতেছে, প্রকল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ে নাই। প্রকল্পটি এমনই নীরক্ত হইয়াছে, যে গ্রামীণ দারিদ্রের ফাঁস আলগা করিবার ক্ষমতা তাহার নাই।
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি, সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পগুলিও বহু মানুষের মৌলিক চাহিদা মিটাইতে পারে নাই। অপুষ্টি, রক্তাল্পতা, অশিক্ষা আজও দারিদ্রের ফাঁদ বুনিতেছে। তদুপরি দরিদ্রের ব্যয়ক্ষমতা কমিবার ফল কী হইবে? মানবোন্নয়নের সূচকে কোথায় থাকিবে এই দেশ? নিষ্ফল দোষারোপ কিংবা বৃথা তর্কের সময় ইহা নহে। যে ধরনের কাজ জোগাইলে দরিদ্রের রোজগার ও ব্যয়ক্ষমতা বাড়িবে, তাহাদের ব্যবহার্য পণ্যগুলির উৎপাদন বাড়িবে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আসিবে, তেমন কাজ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সরকারি অনুদান দিয়া দরিদ্রের ব্যয়ক্ষমতা বাড়াইবার উপযোগিতাও ভাবিতে হইবে। প্রয়োজন উত্তম নীতি ও তাহার কুশলী প্রয়োগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy