দৃশ্য: প্রয়াত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের শেষ বিদায় জানাতে সমবেত সিপিআইএম নেতারা
মা ত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের তিন বিশিষ্ট নেতার প্রয়াণ ঘটল। প্রথমে এম করুণানিধি, তার পরে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং সর্বশেষ অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো এক রাষ্ট্রনায়ক। বাজপেয়ীর অবস্থান ও মান্যতার সঙ্গে বাকি দু’জনের তুলনা করা বাতুলতা। তামিলনাড়ুর আঞ্চলিক রাজনীতিতে ডিএমকে নেতা করুণানিধির বিরাট প্রভাব ছিল বলেই দিল্লিতে তাঁর যথেষ্ট কদর ছিল এবং রাজধানীর রাজনৈতিক ভারসাম্যের খেলায় বার বার তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। সোমনাথবাবু সেই অর্থে রাজ্য রাজনীতির দৈনন্দিনতায় বড় একটা জড়াননি। সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার আগে গত কয়েক দশক ধরে তাঁর কাজকর্ম কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধানত দিল্লিতে। আরও সঠিক ভাবে বললে, লোকসভায় অধ্যক্ষের চেয়ারে বসার আগের দিন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন সংসদে সিপিএমের অপরিহার্য খুঁটি। কিন্তু রাজ্যেই হোক বা দেশে, ক্ষমতার বৃত্তে ওঠাপড়ার খেলা থেকে তিনি বরাবর দূরে থেকেছেন। সেটাই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য।
কিন্তু মৃত্যু কয়েকটি সমাপতনে বাজপেয়ী এবং সোমনাথবাবুকে কোনও এক জায়গায় মিলিয়ে দিল। অটলবিহারী বাজপেয়ীর মতো বিরাট ব্যক্তিত্বকে স্মরণ করতে গিয়ে দলমত নির্বিশেষে সকলেই একবাক্যে বলেছেন, তিনি ছিলেন দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে। সকলকে নিয়ে চলার উদারতা তাঁর ছিল। সোমনাথবাবুর ক্ষেত্রেও বার বার সামনে এসেছে গণতন্ত্র ও সংবিধানের স্বার্থে সঙ্কীর্ণ দলবাজিকে প্রশ্রয় না দেওয়ার প্রসঙ্গ। যার মাসুল দিয়ে তিনি সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হন।
মিল আছে আরও। বাজপেয়ীর অন্তিম অবস্থা থেকে শেষকৃত্য পর্যন্ত গোটা প্রক্রিয়ায় নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহেরা যে ভাবে সব কিছুর নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন, তাতে অনেকেরই মনে হয়েছে এটা তাঁদের ‘অতি ভক্তি’র পরাকাষ্ঠা— যা আর যা-ই হোক, ‘সত্যিকার’-এর শ্রদ্ধা প্রদর্শনের লক্ষণ নয়। অটলবিহারীর মরদেহ নিয়ে বিজেপি দফতর থেকে রাজঘাট পর্যন্ত শুধু শাহকে পাশে নিয়ে মোদীর কার্যত একা হেঁটে যাওয়া দেখে প্রশ্ন উঠেছে, এই কি বাজপেয়ীর মতো সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার নমুনা? গুজরাতে দাঙ্গার সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের উপদেশ দিয়েছিলেন বাজপেয়ী। সেটাও যে ভস্মে ঘৃতাহুতি ছাড়া আর কিছু ছিল না, তেমন কথাও উঠছে।
তুলনীয় উদাহরণ সোমনাথবাবু। লোকসভার অধ্যক্ষ হিসাবে বিবেক এবং নীতিবোধকে দলীয় রাজনীতির কাছে বন্ধক না দিয়ে তিনিও বস্তুত ‘রাজধর্ম’ পালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। মর্যাদা দিয়েছিলেন লোকসভার অধ্যক্ষের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদের দায়িত্বশীলতাকে। আর সেই ‘অপরাধ’-এ তাদের দশ বারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যকে সিপিএম দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল দশ বছর আগে।
এবং একই ভাবে সোমনাথবাবুর প্রয়াণের পরেই দেখা গেল, তাঁর জন্য শ্রদ্ধা-ভক্তি-শোকে বড় বেশি উদ্বেল হয়ে পড়েছে সিপিএম! এতটাই যে, সোমনাথবাবুর পরিবার তাঁদের বাড়ি থেকে সিপিএম নেতা বিমান বসু, মহম্মদ সেলিমদের বেরিয়ে যেতে বলার পরেও তাঁরা মাটি কামড়ে পড়ে থেকেছেন। বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, চট্টোপাধ্যায়-পরিবার কলসির কানা মারলেও সোমনাথবাবুর প্রতি ‘প্রেম’ তাঁদের কমবে না!
বাজপেয়ী অবশ্য আমৃত্যু বিজেপি নেতা ছিলেন। কিন্তু তাতেও কি রেহাই মিলেছে? খবরে প্রকাশ, প্রয়াত অটলবিহারীকে শ্রদ্ধা জানানোর মাপকাঠি কী হবে, তা নিয়েও জলঘোলা হয়েছে বিজেপি ও সঙ্ঘ পরিবারের অন্দরে। লোকসভা নির্বাচন আসন্ন। এখন বাজপেয়ীর উদার মনোভাব ও সর্বজনপ্রিয়তা বেশি করে তুলে ধরতে গেলে মোদীর গায়ে কাদা লাগতে পারে বুঝে বিষয়টি নমো নমো করে চুকিয়ে দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। যদিও শেষরক্ষা হয়নি। তুলনাটি সামনে এসেই গিয়েছে বার বার।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে সিপিএমের অবস্থান আরও হাস্যকর। তাদের অবস্থা না-ফেলার, না-গেলার। তাঁর মতো জাতীয় স্তরে সম্মানিত এক নেতার প্রয়াণের পরে সর্ব স্তরে যে আবহ তৈরি হল, সেই চাপ এড়ানো দলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর তার ফলে ল্যাজে-গোবরে হল গোটা দল।
কলকাতার আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং দিল্লির একেজি ভবনের দু’টি বিবৃতি পাশাপাশি রাখলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে। তাঁর বহিষ্কারের প্রসঙ্গ না তুলেও আলিমুদ্দিন থেকে রাজ্য কমিটি সোমনাথবাবুকে অন্তত ‘কমরেড’ সম্বোধন করে শোকবার্তা দিল। আর দিল্লি থেকে পলিটবুরোর বিবৃতিতে তাঁকে ‘কমরেড’ বলা দূরস্থান, তিনি যে দশ বার লোকসভায় সিপিএমের টিকিটে জিতেছিলেন, সেই উল্লেখটুকু করার সৎসাহসও দেখা গেল না। তবে এটা তাঁরা স্বীকার করেছেন যে, ‘সংবিধানের ভিত সুরক্ষিত রাখতে’ সংসদীয় রাজনীতিতে সোমনাথবাবুর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এখানেই প্রশ্ন, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে তাঁর দল তা হলে সাজা দিয়েছিল কেন? সাংবিধানিক পদকে মর্যাদা দিয়েই তো সোমনাথবাবু লোকসভার অধ্যক্ষের আসনকে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে চেয়েছিলেন। ২০০৪ সালে লোকসভার অধ্যক্ষ হয়ে আর দলের দফতর মাড়াননি। ছেড়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদও। সেই কারণেই ২০০৮-এ ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার জন্য সিপিএম যখন তাদের ৬৪ জন সদস্যের তালিকা তৈরি করে, তিনি সেই তালিকায় থাকতে নারাজ হন। কারণ তিনি মনে করেছিলেন, সংসদে অধ্যক্ষের আসনে বসার পরে দলীয় পরিচয় বহন করা অনৈতিক। তাই দলের হুইপ সত্ত্বেও তিনি অনাস্থা আলোচনার সময়ও অধ্যক্ষের আসনেই ছিলেন। তাঁর অভিমত ছিল, অধ্যক্ষের বেলায় কোনও হুইপ চলে না। তিনি এ সবের বাইরে।
তাঁর এই নীতি ঠিক ছিল কি না, তা বিতর্কের বিষয়। কমিউনিস্ট পার্টিতে এমন নানা বিতর্ক বহু সময় হয়েছে, পরেও নিশ্চয় হবে। কিন্তু দশ বার জেতা সাংসদ সোমনাথবাবুকে বহিষ্কার করতে গিয়ে সিপিএম সে দিন তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগটুকুও দেয়নি। দলীয় গঠনতন্ত্রের ১৯(১৩) ধারার জোরে একতরফা ভাবে তাঁকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। আর সেই বিতাড়ন যজ্ঞে প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা নেন দলের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট। আজ দশ বছর বাদে সোমনাথবাবুর মৃত্যুর দিনেও কারাট নামক জনভিত্তিহীন এই ব্যক্তি তাঁর জন্য একটি শব্দও খরচ করেননি।
অনেকেরই মনে আছে, ‘আই অ্যাম আ কমিউনিস্ট, নট আ জেন্টলম্যান’ বলে প্রয়াত অশোক মিত্র এক সময় আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন। কথাটা বোধ হয় মাঝে মাঝে বড় প্রাসঙ্গিক হয়ে যায়!
কারাট-পরবর্তী সিপিএমে সীতারাম ইয়েচুরিরা অবশ্য চেষ্টা করেছিলেন সোমনাথবাবুকে দলে ফেরানোর। অপমান ও অভিমানে সোমনাথবাবু তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ দলে ফেরার জন্য ফের আবেদন করার প্রস্তাব তাঁর কাছে ছিল দ্বিগুণ অপমানের শামিল।
সেই সিপিএম নেতারা যখন তাঁর মরদেহের পাশে গিয়ে কান্নায় বুক ভাসান, তখন তাতে পাষাণ গলবে ভাবা ভুল। বিমানবাবুরা সেই ভুলের গুনাগার দিয়েছেন।
তিন দিন আগে দিল্লিতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর স্মরণসভায় আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের পরেই বক্তা ছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। সঙ্ঘ প্রধানের কথার জের টেনে তাঁর বক্তৃতায় আডবাণী বলেন, ‘‘উনি যখন অটলজির সম্পর্কে বলছিলেন, মন দিয়ে শুনে ভাবছিলাম অটলজির অনুপস্থিতিতে এই সব না বলে তাঁর সামনে যদি আমরা এগুলি বলতাম, কত ভাল হত!’’হায়! সোমনাথবাবুও দেখে যেতে পারলেন না, তাঁর জন্য সিপিএম নেতারা আজ কত কাঁদছেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy