রথের মেলা। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়
কয়েক দিন আগে ছিল রথযাত্রা। ক’দিন পরেই উল্টোরথ। মাঝের সময়টুকু জগন্নাথ নিয়ে চর্চায় মেতে ওঠেন অনেকে। বিশেষ করে জগন্নাথের ভক্তেরা। তাঁদের কাছে জগন্নাথের সব থেকে বড় উৎসব রথযাত্রা। এই ‘রথযাত্রা’র ‘যাত্রা’ শুধু দেবতার নয়, ভক্তেরও। দেবতার প্রতি ভালবাসার টান থেকেই তো ভক্ত তাঁর রথকে নিয়ে এগিয়ে চলেন। শ্রীচৈতন্যের সময় থেকেই বাঙালির সঙ্গে রথের যোগাযোগ আরও গাঢ় হয়েছে। তা পুষ্ট করেছে বাংলার সংস্কৃতি এবং বাংলা সাহিত্যকেও।
সাধারণ ভাবে রথ বলতে আমরা পৌরাণিক যান বুঝি। যাতায়াতের কাজ ছাড়াও মূলত ঘোড়ায় টানা এই যানের যুদ্ধক্ষেত্রে বহুল ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু রথযাত্রায় যে রথের কথা বলা হয় তার প্রেক্ষিত পুরাণের থেকে অনেকটাই আলাদা। এ রথে নেই কোনও অস্ত্রের ঝনঝনানি। নেই কোনও বৈরিতার সুর। তবে এই রথেও রয়েছে জয়ের বার্তা। শান্তি, মৈত্রী ও প্রেমের জয়।
রথে আসীন বলরাম, সুভদ্রা-সহ প্রভু জগন্নাথ। এই তিন মূর্তি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেক পণ্ডিতের মতে, অনন্তের ব্যঞ্জনা এই তিন মূর্তির রূপকল্পের মধ্যে ধরা পড়ে। বিচিত্র এই রূপের কারণেই বৈষ্ণব থেকে শুরু করে শৈব— সব ধর্মই আপন করে নিয়েছে জগন্নাথকে। তিনি তাই হয়ে ওঠেন শৈবের শিব, বৈষ্ণবের বিষ্ণু। শাক্তমতে তিনি দেবী বিমলার ভৈরব। বৌদ্ধশাস্ত্রে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা যথাক্রমে বুদ্ধ, সঙ্ঘ ও ধর্মেরই প্রতিরূপ। অন্য দিকে, জৈন মতে এই তিন বিগ্রহ তাঁদের ধর্মের আদি প্রবর্তক ঋষভদেব প্রচারিত সম্যক জ্ঞান, সম্যক চরিত ও সম্যক দৃষ্টির প্রতীক। তাই বলা যায়, নানা ধর্মের নানা মতকে এক সুতোয় বেঁধেছেন জগন্নাথ।
জগন্নাথের যে মূর্তির সঙ্গে আমরা পরিচিত তা নিয়েও বহু মত রয়েছে। এক কাহিনিতে বলা হয়েছে, শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুর সময় বলরাম শোকে দুঃখে পাগল হয়ে তাঁর অর্ধদগ্ধ দেহ চিতা থেকে তুলে নিয়ে এসে তা সমুদ্রে নিক্ষেপ করেন। সেই সময় পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সমুদ্রে ভাসমান এক মহাদারু (যা আসলে শ্রীকৃষ্ণেরই অর্ধদগ্ধ দেহ) দেখতে পান। স্বপ্নে নির্দেশ পান, এই মহাদারু দিয়ে বিগ্রহ তৈরি করে মন্দিরে তা প্রতিষ্ঠা করার। কিন্তু কারিগর কে হবেন? তখন স্বয়ং বিশ্বকর্মা বৃদ্ধ, অশক্ত শিল্পী অনন্ত বাসুদেব মহারানা-র রূপে এসে রাজার কাছে শর্ত দিলেন, তিনি এই মূর্তি বানাবেন। কিন্তু যতক্ষণ না মূর্তি তৈরির কাজ শেষ হবে ততক্ষণ কেউই মন্দিরে দরজা খুলতে পারবে না। রাজা তাতে রাজি হলেন। কিন্তু রানি গুণ্ডিচার অত্যধিক কৌতূহলে এবং রাজার অদূরদর্শিতার কারণে ১৫ দিনে পরেই মন্দির দরজা খোলা হয়। রাজা দেখলেন ভিতরে কেউ নেই। শুধু রয়েছে হাত, পা বিহীন এক অসম্পূর্ণ মূর্তি। রাজা তখন নিজের কাজের জন্য মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছেন। এমন সময়ে স্বপ্নে প্রভু জগন্নাথ তাঁকে দর্শন দিয়ে ওই রূপেই তাঁকে প্রতিষ্ঠা করতে বলেন। তখন থেকেই তিনি এই রূপে ভক্তের কাছে পূজা পেয়ে আসছেন।
মূর্তি প্রসঙ্গে শ্রীমদভাগবতের ব্যাখ্যাটি অন্যরকম। শ্রীকৃষ্ণ মথুরা ও বৃন্দাবনলীলা শেষ করে দ্বারকায় রাজা হয়ে বসেছেন। ১৬ হাজার ১৮ জন মহিষী তাঁর সেবা করলেও তিনি রাধার কথা ভুলতে পারছেন না। এক দিন ঘুমন্ত অবস্থায় তিনি ‘হা রাধে’ বলে কেঁদে উঠলে মহিষীরা দেবী রোহিনীর শরণাপন্ন হলেন। তাঁদের অনেক অনুনয় বিনয়ের পরে রোহিনী রাজি হলেন বৃন্দাবন লীলার কথা শোনাতে। একটি বন্ধ ঘরে সুভদ্রাকে বাইরে পাহারায় রেখে মা রোহিনী শুরু করলেন তার বর্ণনা। কৃষ্ণ এবং বলরামও তীব্র এক আকর্ষণে রাজকার্য ছেড়ে চলে এলেন অন্তঃপুরে। তাঁরা ভাবাবিষ্ট হয়ে পাহারারত সুভদ্রার পাশে দাঁড়িয়ে ব্রজলীলার অপূর্ব বর্ণনা শুনতে লাগলেন। ভাবের আবেশে তাঁদের তনু বিগলিত হয়ে গেল। হাত, পা সঙ্কুচিত, চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে সুদর্শন চক্রের আকৃতি লম্বা হয়ে গেল। এমন সময় দেবর্ষি নারদ কৃষ্ণ দর্শনে এসে সেই রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। পরে স্বাভাবিক রূপ প্রাপ্ত হলে নারদের কাছে শ্রীকৃষ্ণ নীলগিরিতে এই রূপে দারুমূর্তি হিসেবে প্রকাশিত হওয়ার কথা বললেন। সেই রূপই আজকের রথের দেবতা।
আষাঢ়ের শুক্ল দ্বাদশীর দিন প্রভু জগন্নাথ তাঁর মন্দির ছেড়ে মাসির বাড়ি যান। এটিই রথযাত্রা। সাত দিন সেখানে কাটিয়ে আবার ফিরে আসেন। এই যাত্রাকে ‘গুণ্ডিচা যাত্রা’ও বলা হয়ে থাকে। ‘রথযাত্রা’ নিয়েও ভিন্ন মত রয়েছে। শ্রীচৈতন্যদেবের মতে, শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরায় আসার পরে ব্রজগোপীরা তাঁর দর্শনে মথুরায় এসে ঐশ্বর্য ও বৈভবের কারণে তাঁর সঙ্গে ভাল ভাবে মেলামেশার সুযোগ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে যান। শ্রীকৃষ্ণ এই খবর পেয়ে বিচলিত হয়ে বছরে এক বার রাজ ঐশ্বর্য্য ছেড়ে বৃন্দাবনে এসে পৌর্ণমাসির কুঞ্জে বিরাজ করেন। এটিই নাকি রথযাত্রা। অন্য মতে, মামা কংস কুমতলবে কৃষ্ণ ও বলরামকে মথুরায় নিয়ে আশার জন্য রথ-সহ অক্রূরকে বৃন্দাবনে পাঠান। তাঁরা যখন রথে করে মথুরায় আসছিলেন তখন কৃষ্ণ ভক্তেরা শোভাযাত্রা করে সেই রথের সঙ্গে যাচ্ছিলেন। সেই ঘটনাটিই রথযাত্রা বলে অনেকে মনে করেন।
রথের আরাধ্য দেবতার রূপ যেমনই হোক না কেন, ভক্তের কাছে তা ভালবাসা নির্ভরতা ও আত্মনিবেদনের। রথযাত্রা হল বাঙালি সমাজের কাছে প্রাণের আনন্দযাত্রা। রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জায়গায় মেলা বসে। মেলা মানেই মিলন। যার মূল সুর সর্বধর্ম সমন্বয়।
রথযাত্রা শুধু উৎসব বা মেলা নয় রথ গতি ও এগিয়ে চলার প্রতীক। তাই পরিবর্তনশীল বিশ্বে বারবার যুগান্তরের প্রতীক হিসেবে কবির কলমে উঠে আসে ‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।/ হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি...’
কাটোয়ার গৃহশিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy