ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে মিছিল। ফাইল চিত্র
নারী নির্যাতনের ঘটনাকে কোনও দেশ-কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে দেখা যায় না, বিশেষ করে যৌন নির্যাতন, যাকে বর্তমান বিশ্বায়নের সহগামী ও সমানুপাতিক বলা চলে। ধর্ষণ সেই যৌন নির্যাতনেরই এক চরম প্রকাশ। সাধারণ ছাপোষা মানুষ এমনকি আইনের রক্ষকেরাও অনেক সময়ে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধের ব্যাপ্তি অনুধাবনে ব্যর্থ হন। ফলে এমন জঘন্য অপরাধও ধামাচাপা পড়ে যায়।
বহু দিন ধরে ধর্ষণের সংজ্ঞায় নারীর অনুমতি ও অননুমতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ধর্ষণ হয়েছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য বিশেষ ক্ষেত্রে যৌন আচরণের প্রতি নারীর অনুমতিই প্রাথমিক ভাবে বিবেচ্য ছিল। কিন্তু এ ভাবে ধর্ষণকে নির্দেশ করা যথার্থই সম্ভব নয়। কারণ, অনুমতি আদায়ের জন্য ভীতি প্রদর্শন, মিথ্যা আশ্বাস ইত্যাদির অবলম্বন বহুল প্রচলিত। তা ছাড়া, শিশুদের ক্ষেত্রে অনুমতির বিষয়টি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। তার জন্যই বর্তমানে আইনি পরিভাষায় এই সংজ্ঞার পরিসর বৃদ্ধি করে বলপ্রয়োগে যে কোনও ধরনের যৌন আচরণকেই ধর্ষণের শামিল বলা হয়েছে।
অনুধাবনযোগ্য বিষয় হল, ধর্ষণের কোনও একটি নির্দিষ্ট ধাঁচ বা ধরন চিহ্নিত করা যায় না। বরং এর বিভিন্নতা অবাক ও লজ্জিত করে। স্বামী, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, পরিচিত ও অপরিচিত ব্যক্তি দ্বারা নারী তো ধর্ষিতা হয়েই থাকেন। এ ছাড়াও, দলবদ্ধ ভাবে ধর্ষণ, একই ব্যক্তির দ্বারা বিভিন্ন নারীর ধারাবাহিক ধর্ষণ, শাস্তিমূলক বা প্রতিহিংসামূলক ধর্ষণ, পুলিশি হেফাজতে ‘ধর্ষণ’, রক্ষক দ্বারা ধর্ষণ (বিশেষ করে হস্টেল বা মানসিক ভারসাম্যহীন নারীদের আবাসে), জাতিগত বৈষম্যমূলক ধর্ষণ, প্রথাগত ধর্ষণ (নববিবাহিতার প্রতি পরিবার বা গ্রামের প্রধানের প্রথম যৌন অধিকার) থেকে সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন বা দাঙ্গার সময়ে ধর্ষণ বা যুদ্ধকালীন ধর্ষণ— এ তালিকা শেষ হওয়ার নয়।
কিন্তু কেন? যুগ যুগ ধরে নারীর উপরে এমন নৃশংসতার কারণ কী? আশা করা যায় যে, যথার্থ কারণ অনুসন্ধানে হয়তো এই অপরাধে রাশ টানা যাবে। জনপ্রিয় যুক্তি হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের সঙ্গে যৌন পরিতৃপ্তির কোনও সম্পর্ক থাকে না। কাজেই নারীর পোশাক, খোলামেলা আচরণ বা বেশি রাত পর্যন্ত বাইরে থাকার সঙ্গে যাঁরা ধর্ষণের সম্বন্ধ খুঁজে পান, তাঁরা অবশ্যই কোনও-না-কোনও বিভ্রান্তির শিকার। কারণ, সেই অভিমত দু’বছরের কোনও শিশু বা আশি বছরের কোনও বৃদ্ধার ধর্ষণকে ব্যাখ্যা করতে পারে না। দাঙ্গাকালীন ধর্ষণও এই অভিমত বিশ্লেষণ করতে পারে না।
ধর্ষণের সঙ্গে বরং পুরুষের অধিকারবোধ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, কর্তৃত্বের হতাশা, নারীর উপরে ক্ষমতা কায়েম করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা, নারীর সাফল্যে ঈর্ষাজনিত হীনমন্যতা ও তার ফলে তৈরি হওয়া নিরাপত্তাহীনতা, রোষ ও ভয়, ধর্ষকামী মানসিকতা, মাদকাসক্তি, অশ্লীল ছবিতে আসক্তি ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। আমাদের দেশের অনেক ধর্ষণের ঘটনাই তার সাক্ষী।
বাড়ির ঘনিষ্ঠ ও বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা নাবালিকার ধর্ষণের ক্ষেত্রে আবার তার প্রতি ধর্ষকের এক ধরনের স্বত্বাধিকার বোধ দেখা যায়, যেখানে সে মনে করে বাড়ির সমস্ত নারীই তার ভোগ্যবস্তু। কখনও আবার এরা দাবি করে, নাবালিকার প্রতি তাদের দায়িত্ব, ভালবাসা ও আকর্ষণ এতই প্রবল যে তা যৌন আকর্ষণে রূপ পায়।
আমাদের লক্ষ্য, ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ রোখার চেষ্টা করা। অনেকেই বলেন, মৃত্যুদণ্ড এর উপযুক্ত শাস্তি। কারণ, এই অপরাধ নিপীড়িতার উপরে দীর্ঘকালীন যে দৈহিক-মানসিক ক্ষত তৈরি করে, তা মৃত্যুরই শামিল। বিশ্বের বেশ কিছু দেশে তাই এখনও ধর্ষণের জন্য মৃত্যুদণ্ডই প্রচলিত রয়েছে। আমাদের দেশেও ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। যদিও তার বিরোধিতাও হয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, মৃত্যুদণ্ড কি এমন ন্যক্কারজনক অপরাধে রাশ টানতে পারবে। এই প্রশ্নের সদর্থক উত্তর দেওয়া কঠিন, কারণ তা যথার্থ নয়। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধী কারাগারের চার দেওয়ালের ভেতরে চরম শাস্তির সম্মুখীন হয়, যার ভয়াবহতা বাইরের জগতের কাছে প্রকাশিত হয় না। ধর্ষণকামীদের উপরে এমন শাস্তির কোনও প্রভাবই পড়ে না। যদি এমন বিধান দেওয়া যেত যে, অপরাধীদের নিপীড়িতার বাড়ির সামনে পিটিয়ে হত্যা করা হবে, তা হলে হয়তো এদের মনে কিছুটা হলেও ভয়ের সঞ্চার হত। কিন্তু এমন শাস্তি বর্বরতারই নামান্তর, যা কোনও সভ্য দেশেই
সুপারিশযোগ্য নয়।
অন্য অপরাধীদের মতো ধর্ষণে অভিযুক্তেরাও অনেকাংশে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ভোগ করে। পুলিশও সময়মতো নিপীড়িতার বা তাঁর পরিবারের অভিযোগ নেয়নি, এমন অভিযোগও ওঠে। অথচ কে না জানে, ধর্ষণের মতো অপরাধ প্রমাণে ঘটনার পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাই সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে অপরাধী বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। এই কারণেই ভারতে ধর্ষণের অপরাধে মাত্র ২৭ শতাংশ দোষী সাব্যস্ত হয়।
এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে তাই আইন প্রক্রিয়া দ্রুততর করা একান্ত আবশ্যক। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে ছ-আট মাসের মধ্যে সাজা ঘোষণা হলে মানুষেরও বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়বে। এ ক্ষেত্রে সরকারি স্তরেও অনেক গাফিলতি দেখা যায়, যা কার্যত নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী। ধর্ষণের মতো অপরাধের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৩ সালে ৩১০০ কোটি টাকার ‘নির্ভয়া তহবিল’ গঠন করলেও প্রায় কোনও রাজ্যেই তার সুষ্ঠু প্রয়োগ হয়নি। প্রায় ৯০ শতাংশ টাকাই পড়ে রয়েছে। নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা যেখানে প্রশ্নের মুখে, সেখানে এমন গাফিলতি মানা যায় না।
অথচ এই টাকার অনেকটাই ধর্ষণের মতো অপরাধ রুখতে জনচেতনা তৈরিতে ব্যবহার করা যেত। স্কুল-কলেজের পাশাপাশি জেলা ও পঞ্চায়েত স্তরেও নানা কর্মশালা আয়োজন করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাধারণের মধ্যে সচেতনতা প্রসার করা জরুরি। এই বিষয়ে নারীর পক্ষে কী আইন আছে এবং সেই আইনি সহায়তা কী ভাবে পাওয়া যায়, সেই বিষয়েও সচেতনতা দরকার। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলিরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আর দরকার, শিশু বয়স থেকেই মেয়েদের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধিকার বোধের ভাবনা জাগিয়ে তোলা। তা হলে তার মধ্যে সামাজিক হীনমন্যতার ভাব জন্মাবে না। যৌন নিপীড়নের শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে তা গোপন করার চেষ্টা করবে না। পাশাপাশি, প্রতিটি স্কুলেই মেয়েদের জুডো, ক্যারাটে ইত্যাদি আত্মরক্ষামূলক বিষয়গুলি বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। নারী সব বিষয়ে আত্মনির্ভর হয়ে উঠতে পারলে সুরক্ষিত জীবন কাটাতে পারবে।
লেখক বাঁকুড়া জিলা সারদামণি মহিলা মহাবিদ্যাপীঠে দর্শনের শিক্ষিকা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy