২০১২ সালের ডিসেম্বরে নির্ভয়া ঘটনায় সারা ভারত কেঁপে ওঠার সাত বছর পরে, ২০১৯-এর নভেম্বরে আবার জনমানসকে স্তম্ভিত করে ফিরে এল ভয়াবহতার চূড়ান্তে অধিষ্ঠান করা আর এক ধর্ষণকাণ্ড— তেলঙ্গানায়। ধর্ষণ আমাদের দেশে প্রতি দিন অসংখ্য ঘটছে, তবু অবাক হয়ে শুনলাম, ২৮ নভেম্বর থেকে আজ অবধি ভারতের সাত আট জায়গায় কতগুলি বড় ধর্ষণকাণ্ডের খবর এসেছে। খবর হয়নি এমন আরও অসংখ্য কাণ্ড ঘটে গিয়েছে, ধরেই নিতে পারি।
যে-দেশে পুলিশের কাছে গেলেও বিচার পান না মেয়েরা, সেই দেশে পুলিশও কি আসলে পরোক্ষে ধর্ষকের হাত শক্ত করে না? নির্ভয়া কাণ্ডের পর দেশজোড়া হইচইয়ের ফলে অনেক আইনি পরিবর্তন আনার হল, কিন্তু আজও ফাস্ট ট্র্যাকে ধর্ষণ কেস সমাধান করার ধারা তৈরি হল না। এ দিকে নির্ভয়াকে নিয়ে সিনেমা, ডকুমেন্টারি, ওয়েব সিরিজ় ইত্যাদি হয়ে গেল বেশ কয়েকটা।
আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রের ‘ডিপ স্ট্রাকচার’ বা গভীরে চারিয়ে থাকা কাঠামোর কথা নতুন করে বলার নেই। প্রতি দিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ছোট ছোট অপমান মেয়েরা কেন গিলছেন? সবচেয়ে বড় কথা, সমাধান হিসেবে মেয়েদের ওপর ফতোয়া না নামিয়ে এনে, বাড়ির ছোট ছেলেদের মানুষ করার সময়ে ঠিক শিক্ষা দেওয়ার কাজটিতে কেন আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না? কেন বলছি, “আমার মেয়ের জন্য চিন্তা হয়, ও রাতে বেরোয়”, কিন্তু বলছি না, “আমার ছেলের জন্য চিন্তা হয়, ও মেয়েদের ঠিক কী চোখে দেখে?’’
আর্থ-সামাজিক ভাবে যাঁরা কোনও শিক্ষাই পাননি, তাঁদের কী ভাবেই বা আমরা প্রশিক্ষিত করব? সমাজের দায়িত্ব যদি হয় পুরুষ-নারী নির্বিশেষে ছোট্ট বয়স থেকে এই মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া, রাষ্ট্রের দায়িত্ব তো আরও আগে— তার কাজ ছিল তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীর পুরুষতান্ত্রিক অশিক্ষাটাকে উপড়ে ফেলা। প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবেদনের ন্যূনতম শিক্ষাটা দেওয়া।
আমাদের শিক্ষিত বৈঠকখানার আড্ডায় আগে ধর্ষণ শব্দটির প্রবেশাধিকার ছিল না। এখন ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা অবাধে হয়। সে রকম এক আড্ডায় আমেরিকা-ফেরত কোনও পুরুষ বন্ধু হাসতে হাসতে সে দিন বললেন, ‘‘আমেরিকাতে পুলিশ জেরবার। পার্টিতে মদ্যপান করে তার পর যত্রতত্র বিহার করবে ছেলেমেয়েরা, তার পর সেক্স হলেই, পর দিন ছাত্রী এসে বলবে, আমাকে রেপ করেছে অমুক ছাত্র। পুলিশ কী করবে বলুন তো? চোর ডাকাত খুনি ধরবে, না এই সব ছুটকো-ছাটকা ধর্ষণ কেসে মূল্যবান ‘ম্যান-ডে’ নষ্ট করবে?’’
আসল সমস্যাটা এখানেই। এখনও আম-পুরুষের কাছে ধর্ষণ ‘ছুটকো-ছাটকা’ বিষয়, লঘু চোখে দেখার বিষয় (যত ক্ষণ না একটি নির্ভয়া বা অনুরূপ ঘটনায় তাঁরা ‘লজ্জিত’ বোধ করেন!)। তেমনই পুলিশের কাছেও ধর্ষণ/ যৌন নির্যাতন ‘লো-প্রায়োরিটি’, তার গুরুত্ব কম। আইনি ব্যবস্থাকে যদি একটি পরিষেবা ভাবি, আর বাদী পক্ষকে ভাবি তার ‘ক্লায়েন্ট’, বা উপভোক্তা? তা হলে, সব অভিযোগের মধ্যে উপরে আসবে গোষ্ঠী, সংস্থা, জাত, ধর্ম, সম্পদের বিবেচনা। সবচেয়ে নীচের ‘প্রায়োরিটি’ মেয়েরা। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন ‘সফট ক্রাইম’। আগে তো ডাকাত ধরবে পুলিশ। উগ্রপন্থী ধরবে। খুনি ধরবে। সে সব ক্ষেত্রে আবার বাদী পক্ষ হয় রাষ্ট্র নিজেই বা কোনও বড়সড় সংস্থা। সেখানে একটি মেয়ের ক্ষমতা কতটা? তাঁকে কেন গুরুত্ব দেবে পুলিশ?
মেয়েদের প্রশ্ন তোলা উচিত এই জায়গাটাতে। আজকের সমাজে মেয়েরা কর দিচ্ছেন, ভোটাধিকার প্রয়োগ করছেন। তা হলে মেয়েদের সুরক্ষার দাবি কেন এত তলায় পড়ে থাকবে?
মেয়েদের সমস্যাকে শুধু ‘মেয়েদের’ বলে সরিয়ে রাখার এই প্রবণতাকে চিহ্নিত করতে হবে। সংস্কার করতে হলে প্রতিটি সংস্থাকে চিহ্নিত করে এই মানসিক সংস্কার আগে করতে হবে। জেন্ডারকে তুল্যমূল্য করে দেখার সচেতনতা আগে চাইতে হবে। বিদেশে বহু আন্দোলনের পর এখন কিছুটা হলেও হয়তো সুরাহা হয়েছে। আইন শক্ত করার পাশাপাশি জেন্ডার সচেতনতার ট্রেনিং, ধর্ষণ বা অন্যান্য যৌন নির্যাতনের কেসে পুলিশের সংবেদনশীলতার ট্রেনিং দিতে হবে পুলিশবাহিনীকে। না হলে, নির্ভয়া ফান্ড-ই গঠন হোক আর তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে রাস্তায় চারটে আলো বেশি বসানো বা ১০০ নম্বরে ফোন করার বিধান দেওয়া হোক, এগুলো কোনও কাজ করবে না।
আর হ্যাঁ, মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরোতে না দেওয়া বা রাতে একা চলাফেরা না করতে বলা কোনও সভ্যতাসম্মত সমাধান নয়। যিনি আক্রান্ত— তাঁকেই পায়ে বেড়ি পরানোর সমাধান একমাত্র সমাজেই চলে। এত দিনের লড়াইতে মেয়েরা যেটুকু বাইরে বেরোনোর অধিকার অর্জন করেছেন, এক একটা এই ধরনের চূড়ান্ত ঘটনার ধাক্কায় তা এক পা করে পিছিয়ে যায়।
আর আমরা— অপেক্ষা করি এক একটা ভয়াবহতম বিরলতম ঘটনার জন্য। যাতে জেগে উঠতে পারি মোমবাতি হাতে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy