পার্লামেন্টে দলের সদস্যসংখ্যা মাত্র এক— তাও সরাসরি ভোটে জিতে নয়, দলের সার্বিক ভোটের হিসাবে প্রাপ্ত আসনের কল্যাণে। আর, সেই একমাত্র সাংসদকেই বেছে নেওয়া হল শ্রীলঙ্কার নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। তিনি রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে আগের প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ছোট ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে পদত্যাগ করার পর এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, যিনি এই ঘোর দুঃসময়ে এই দায়িত্ব গ্রহণে প্রস্তুত। রনিল কাঁটার মুকুট পরতে সম্মত হয়েছেন।
কাঁটার মুকুটই বটে। রাজাপক্ষে ভাইদের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে শ্রীলঙ্কার অর্থব্যবস্থা বিধ্বস্ত। বৈদেশিক ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ দেশ; রান্নার গ্যাসের দাম পৌঁছে গিয়েছে সিলিন্ডারপ্রতি ৫০০০ টাকায়; তুমুল খাদ্যসঙ্কট; গোটা দেশে নাকি এক ফোঁটা পেট্রল-ডিজ়েল নেই; হাসপাতালে ওষুধ নেই, বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, মূল্যস্ফীতির হার ৪০ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছে। নাগরিক বিক্ষোভ ক্রমে হিংসাত্মক হয়ে উঠছে। এমন সময় বিক্রমসিঙ্ঘের চেয়ে ভাল প্রধানমন্ত্রী পাওয়াও অবশ্য দুষ্কর ছিল। এর আগে পাঁচ বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন ৭৩ বছর বয়সি এই রাজনীতিক। গোতাবায়া-মাহিন্দা জমানার সঙ্গে তাঁর দু’টি পার্থক্য অতি স্পষ্ট, এবং এই বিপন্ন সময়ে মোক্ষম। প্রথমত, পশ্চিমি দুনিয়ার সঙ্গে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের সম্পর্ক ভাল। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর— সে রকম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী ভাবে আলোচনা চালিয়ে যেতে হয়, রনিল জানেন। এই বিপর্যয় থেকে নিস্তার পেতে হলে অর্থ ভান্ডারের সাহায্য ছাড়া নান্য পন্থা, শ্রীলঙ্কার ক্ষমতার অলিন্দে সে কথা নিয়ে এখন কোনও সংশয় নেই। ফলে, রনিল বিক্রমসিঙ্ঘেই তাদের সেরা বাজি। এই লেখা প্রেসে যাওয়া অবধি আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার বা বিশ্ব ব্যাঙ্কের থেকে বিশেষ কোনও প্রতিশ্রুতি আদায় করা যায়নি ঠিকই, কিন্তু কাজটা পারলে যে রনিলই পারবেন, তা নিয়ে শ্রীলঙ্কায় সংশয় নেই। আর্থিক সংস্কারের পথে হাঁটবেন তিনি, সেই ইঙ্গিত দিয়ে বিক্রমসিঙ্ঘে জানিয়েছেন, সে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান সংস্থার বিলগ্নিকরণের কথাও ভাবছেন তিনি।
দ্বিতীয় কারণ হল, রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে একটা দুরূহ ভারসাম্যের খেলায় দড়— চিন আর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রাখার খেলা। রাজাপক্ষে ভাইদের আমলে চিনের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠতায় অন্য বহু দেশের থেকে দূরে সরে গিয়েছিল শ্রীলঙ্কা, ভারত তাদের মধ্যে অন্যতম। দেশে আর্থিক বিপদ প্রকট হওয়ার পরে বিশেষত পশ্চিমি দুনিয়া যে ভাবে গা বাঁচিয়ে থেকেছে, তা রাজাপক্ষে ভাইদের চিন-নীতিরই ফল। রনিল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে বিনিয়োগ করেছেন তাঁর আগের দফাতেই। ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে চার বার ভারত সফরে এসেছিলেন তিনি। তাঁর আমলেই নরেন্দ্র মোদীও দু’বার শ্রীলঙ্কা সফরে গিয়েছেন। ফলে, ভারতের কাছে সাহায্য এবং আন্তর্জাতিক স্তরে মধ্যস্থতা প্রার্থনা করতে বিক্রমসিঙ্ঘের সমস্যা কম। এই ক্ষেত্রে অন্তত হাতে হাতে প্রমাণ মিলছে। ভারত ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ত্রাণ পাঠিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। এবং, দৃষ্টান্ত তৈরি করে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক শ্রীলঙ্কার সরকারকে ধার দিয়েছে ১০০ কোটি ডলার। দৃষ্টান্ত, কারণ ভারতের কোনও বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক কোনও বিদেশি সরকারকে সরাসরি ঋণ দিচ্ছে, এমন নজির এর আগে নেই। নজিরটি সরকারি অনুমতি বিনা স্থাপিত হয়নি, আঁচ করা চলে।
অবশ্য, শুধু আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বচ্ছন্দ হওয়ার জন্যই নয়, রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের গ্রহণযোগ্যতার অভ্যন্তরীণ কারণও আছে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে তিনি উদারবাদী হিসেবে পরিচিত, বিশেষত সংখ্যালঘু তামিল প্রশ্নে। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেই এলটিটিই-র সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এমনকি তিনি তামিল জঙ্গিদের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাবও দেন। চন্দ্রিকা কুমারতুঙ্গা থেকে মাহিন্দা রাজাপক্ষে, শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে ক্ষমতাবান অনেকেই বিভিন্ন সময়ে রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের তামিলদের প্রতি ‘অতি শিথিল’ মনোভাবের সমালোচনা করেছেন। এই চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার সাধারণ মানুষের কাছে গণতন্ত্র এবং সহিষ্ণুতার গ্রহণযোগ্যতা হঠাৎই বেড়েছে অনেকখানি। সেই সুবাদে জনপ্রিয়তা বেড়েছে রনিলেরও।
এ মাসের ১২ তারিখ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ষষ্ঠ বারের মতো শপথ নিয়ে বিক্রমসিঙ্ঘে জানিয়েছিলেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন এই বিপদ থেকে দেশকে উদ্ধার করা সম্ভব। তার আগেই জানিয়েছিলেন, দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা যাতে গ্রিস বা গত শতকের ইন্দোনেশিয়ার পথে না হাঁটে, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী হয়ে ঘোষণা করেছেন, আগামী কৃষি মরসুমের জন্য বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক সার আমদানি করার কথা। তবে, অফ স্ট্যাম্পের বাইরের বলে খোঁচাও দিয়েছেন তিনি। এই সময় বিদেশি টুরিস্টদের শ্রীলঙ্কায় আসা উচিত কি না, এক টেলিভিশন ইন্টারভিউয়ে এই প্রশ্নের উত্তরে রনিল বলেন, অ্যাডভেঞ্চার চাইলে আসুন। দেশ জুড়ে বিস্তর হইচই হল, তিনিও কাঁচুমাচু। তবে, এই ভয়াবহ সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের চাপে দু’চারটে কথা মুখ ফস্কে বেরোতে পারে, অস্বীকার করার উপায় নেই।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy