নজরুল ইসলাম
‘বসন্ত'র একটি কপিতে নিজের নামটি লিখে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘‘তাকে বোলো, আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোনো কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিও তো চাই।’’ সে সময় সরকারবিরোধী ব্যঙ্গধর্মী কবিতা-রচনার অপরাধে অভিযুক্ত সেই রাজবন্দি বইটি পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন এবং সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন— ‘‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমাকে উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা ক্লেশ ভুলে যাই।’’ হয়তো কবিগুরুর কাছে কবি স্বীকৃতি পাওয়ার প্রেরণাতেই সেই আলিপুর জেলে তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা, ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’। সেই কবিতায় তিনি লিখেছিলেন— আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।
নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না সেই সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যিনি মেতেছিলেন তিনি ছিলেন কবি নজরুল ইসলাম। ইংরেজি ১৯২২ সাল ১২ অগস্ট দিনটিতে ‘ধূমকেতু’ নাম নিয়ে কলকাতার ৩২ নম্বর কলেজ স্কোয়ার থেকে প্রকাশিত হল একটি অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা। পৃষ্ঠা সংখ্যা আট। প্রতি সংখ্যার নগদ মূল্য এক আনা এবং বার্ষিক পাঁচ টাকা। সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের অচলায়তনকে ভেঙেচুরে নতুন যুগচেতনায় দেশবাসীদের উদ্বুদ্ধ করার পবিত্র সংকল্প নিয়ে ধূমকেতুর সারথিরূপে মূর্ত বিদ্রোহ নজরুল আর্বিভূত হলেন। ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যায় তিনি লিখেছিলেন—‘দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভন্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ‘ধূমকেতু’ হবে আগুনের সম্মার্জনী।
হিন্দু মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথও সম্পাদক নজরুলের ‘ধুমকেতু’কে আশীর্বাদ জানিয়ে স্ফুলিঙ্গের ১৭তম কবিতায় লিখেছিলেন, আয় চলে, আয় রে ধুমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু/ দুর্দিনের ঐ দুর্গশিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের ব্যর্থতায় ঝিমিয়ে পড়া ও নৈরাশ্যপীড়িত বিপ্লবীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ধূমকেতু যে দুরূহ ও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার।
১৩২৯ সালের ১৭ কার্তিক তারিখের ধূমকেতুর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ নিশান বরদার পতাকাবাহীতে তিনি লিখেছিলেন— ‘ওঠো ওগো আমার নির্জীব ঘুমন্ত পতাকাবাহী বীর সৈনিক দল। ওঠো, তোমাদের ডাক পড়েছে, রণ-দুন্দুভি রণ-ভেরী বেজে উঠেছে। তোমার বিজয় নিশান তুলে ধরো। উড়িয়ে দাও উঁচু করে, তুলে দাও যাতে সে নিশান আকাশ ভেদ করে উঠে। পুড়িয়ে ফেল এ প্রাসাদের উপর যে নিশান বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের উপর প্রভুত্ব ঘোষণা করছে।...বল আমরা সিংহশাবক, আমরা খুন দেখে ভয় করি না।’ ধূমকেতুর পুচ্ছ তাড়নায় অস্থির হয়ে অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকার নজরুলের কণ্ঠরোধ করার ফিকির খুঁজতে লাগল। নজরুল কিন্তু ভয়হীন চিত্তে অগ্নিগর্ভ প্রবন্ধ, কবিতা, হাস্য- কৌতুক প্রভৃতির মধ্য দিয়ে এক দিকে শাসক শ্রেণীর অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপর দিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভন্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর শক্তিশালী লেখনী চালিয়ে যান। ‘ধূমকেতু’তে প্রকাশিত অনেক রচনার জন্যই নজরুলকে রাজদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত করা যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’র জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহমূলক মোকদ্দমা আনা হয়। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর দ্বাদশ সংখ্যা 'আনন্দময়ীর আগমনে' শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখেছিলেন— ‘আর কত কাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/ স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল/ দেব শিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ ভূ-ভারত আজ কসাইখানা—আসবি কখন সর্বনাশী ? এর পর ইংরেজ সরকার আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকেনি।
১৯২২ সালের ৮ নভেম্বর সকাল বেলা ৭ নম্বর প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের ‘ধূমকেতু’র অফিসে এক দল পুলিশ হানা দিয়ে নজরুলের খোঁজ করে। তাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি দন্ডবিধি আইনের ১২৪ (ক) এবং ১৫৩ (ক) ধারা মতে রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা ছিল। কিন্তু নজরুলকে না পেয়ে অফিসে তল্লাশি চালিয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ (বারোশো সংখ্যা) ও লীলা মিত্রের কবিতা ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ (পনেরোশো সংখ্যা) বাজেয়াপ্ত করে। এর পর পুলিশ ধূমকেতুর প্রকাশক ও মুদ্রাকর আফজালুল হককে গ্রেফতার করেন। কিছু দিন পর ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে কবিকে আটক করে পরদিন কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ও প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয় এবং ওই দিনে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটিকেও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯২২ সালের ২৫ নভেম্বর কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া পরিয়ে কবিকে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইন হোর এজলাসে হাজির করা হলে, ২৯শে নভেম্বর শুনানির দিন ধার্য করা হয়। নজরুলের পক্ষ সমর্থন করে সলিল মুখোপাধ্যায়-সহ বেশ কয়েক জন আইনজীবি এগিয়ে আসেন। ১৯২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি রবিবার দুপুরে প্রেসিডেন্সি জেলে বসে আত্মপক্ষ সমর্থনে রচনা করেন, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। ৮ জানুয়ারি তা কোর্টে পেশ করা হয়। তিনি লিখেছিলেন—‘আমার ওপর অভিযোগ আমি রাজ বিদ্রোহী, তাই আমি আজ রাজ কারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।...আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। তা রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পার, ধর্মের আলোকে, ন্যায়ের দুয়ারে তা নিরপরাধ, নিষ্কলুষ, অম্লান, অনির্বাণ, সত্য ও সুন্দর।...সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এ বার ভগবানের হাতে অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায়-অত্যাচার দগ্ধ করবে।’ আদালতে কবির সেই জবানবন্দী সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য নজির হয়ে থাকলেও তাকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তথ্য ঋণ: ১) কারাবাসে নজরুল শান্তনু ঠাকুর, গণকন্ঠ (২০০০-২০০১) ২) রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত , ৩) নজরুলের সাংবাদিকতা ডঃ সুশীল কুমার গুপ্ত, শতকথায় নজরুল, ৪) কাজী নজরুল ইসলাম- স্মৃতিকথা , মুজফ্ফর আহমেদ এবং ৫) রাজবন্দী কবি নজরুল : আইউব হোসেন, সৃজনী সাহিত্যপত্রিকা ।
শিক্ষক, কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুল
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy