শিলংয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি। ছবি: লেখক
বাড়ি ফিরেই নোটবই খুলল অমিত রায়। নোটবইয়ের পাতায় খসখস করে লিখল—“পথ আজ হঠাৎ এ কী পাগলামি করলে! দুজনকে দু জায়গা থেকে ছিঁড়ে এনে আজ থেকে হয়তো এক রাস্তায় চালান করে দিলে।”
শিলংয়ের পাহাড়ি পথের চড়াই-উৎরাই মাঝে মাঝে পাগলামি করে বইকি! পথের কোথাও কোথাও পাকদণ্ডী দেখলে গা শিউরে ওঠে। গাড়ি ধাক্কা খেলে মৃত্যু অনিবার্য। অনেক সময় মোটর গাড়ির ধাক্কা নতুন সম্পর্কেরও সূচনা করে। মুখোমুখি ধাক্কা লাগাটা এ পথে অস্বাভাবিক কিছু নয়। মুহূর্তে রোদ্দুর ঢেকে ঝেঁপে বৃষ্টি আসাটা শিলংয়ের বৈশিষ্ট্য। বৃষ্টির আবহাওয়ায় ‘শেষের কবিতা’-র নিবারণ চক্রবর্তী প্রথম আবৃত্তি করল—“পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি / আমরা দুজন চলতি হাওয়ার পন্থী।”
আমরা দু’জন— অমিত রায় আর লাবণ্য। শিলং পাহাড়ে ওদের প্রথম দেখা। তার পরে প্রণয়, মান-অভিমান, বিচ্ছেদ। ঠিক যেন ক্ষণে ক্ষণে প্রকৃতির রূপ বদলানোর মতো। শিলংয়ে না গেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ‘শেষের কবিতা’ লিখতেন না।
এই উপন্যাসের পটভূমি শিলং। এটি নাকি রবীন্দ্রনাথ শিলংয়ে বসেই লিখেছিলেন, তাই শিলং এত প্রাণবন্ত। সাধারণের মধ্যে এই রকম একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কিন্তু জানা গিয়েছে, এই উপন্যাসের এক পাতাও তিনি শিলংয়ে লেখেননি। শিলংয়ে বসে তিনি লিখেছিলেন ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসের কয়েকটা অধ্যায় এবং ‘রক্তকরবী’ নাটক। বিভিন্ন সূত্রে থেকে জানা যায়, কলম্বোয় অসুস্থ শরীর নিয়ে ‘শেষের কবিতা’ লেখা শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুরুতে নাম দিয়েছিলেন ‘মিতা’। তখন এটা ছিল গল্প। কিন্তু শিলংয়ের প্রকৃতি কবির ‘মিতা’ গল্পের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। লখনউ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বেঙ্গালুরুর বাড়িতে থাকাকালীন মিতার পুনর্নির্মাণ করেন তিনি। নাম দেন ‘শেষের কবিতা’। কলম্বোর মতো বেঙ্গালুরুতেও ‘যোগাযোগ’ ও ‘শেষের কবিতা’ একই সঙ্গে লিখতেন কবি। দু’টো লেখার ভাষা ও ধরন সম্পূর্ণ আলাদা, তবুও কবির পক্ষে কী ভাবে সম্ভব হয়েছিল দু’টি একই সঙ্গে লেখা?
“অমিট রায়দের নিয়ে যখন পড়ি, তখন সিসি, লিসি, কেটি, ওদের ফ্যাশানেবল্ সমাজ, সমস্ত অ্যাট্মস্ফিয়ারটা মাথার মধ্যে জমে ওঠে। তার মধ্যে লাবণ্য, লাবণ্যর মাসী একেবারে অন্য জাতের মানুষ। লাবণ্যর সঙ্গে যে আমার চেনা-শোনা আছে, খুব যেন তাকে দেখেছি।”— নির্মলকুমারী মহলানবিশের প্রশ্নের উত্তরে এমনই জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
‘শেষের কবিতা’ কি নিবারণ চক্রবর্তীর প্রথম কবিতা ? উপন্যাসে অমিত রায় বলেছে, “ও (নিবারণ চক্রবর্তী) প্রত্যেক বারেই যে কবিতা লেখে সে ওর প্রথম কবিতা। সেদিন ওর খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে অল্পদিন আগেকার একটা লেখা পাওয়া গেল। ঝরনার উপরে কবিতা—কী করে খবর পেয়েছে শিলং পাহাড়ে এসে আমার ঝরনা আমি খুঁজে পেয়েছি।” বলার অপেক্ষা রাখে না শিলং, চেরাপুঞ্জির পাহাড় জুড়ে রয়েছে ঝরনার সারি। “ঝরনা তোমার স্ফটিক জলের/ স্বচ্ছ ধারা/ তাহারি মাঝারে দেখে আপনারে/ সূর্য তারা।” স্ফটিক জলের স্বচ্ছ ধারার নেপথ্যে ‘শেষের কবিতা’-র নায়িকাকে লাবণ্যময়ী করেছেন রবীন্দ্রনাথ। উপন্যাস জুড়ে এই ভাবে সব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চলে এসেছে শিলং পাহাড়। মোটরে মোটরে সংঘাত, অমিত-লাবণ্যের পরিচয়, ঘটকালি, বাসা বদল, শেষ সন্ধ্যা, মুক্তি ইত্যাদি। উপন্যাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “সাত দিন যেতেই অমিত ফিরে যোগমায়ার সেই বাসায় গেল। ঘর বন্ধ, সবাই চলে গেছে। ...সমস্ত শিলঙে পাহাড়ের শ্রী আজ চলে গেছে।”
শ্রী হারিয়েছে কবির বাসভূমি ‘জিৎভূম’-ও। শ্রী হারিয়েছে রবি-স্মৃতির সেই ‘ব্রুকসাইট’ বাংলো। লোকজন নেই, খাঁ খাঁ করছে বাংলোটি। এক সময় এই বাংলোয় কত রাত কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কত মানুষই না এসেছেন এখানে। সাহিত্যচর্চায় মুখর থাকত বাংলোটি। উল্লেখ্য, ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে এই বাংলোটিকেই তিনি কল্পনা করেছিলেন যোগমায়ার বাড়ি আর জিৎভূমের বাড়িটিকে কল্পনা করেছিলেন অমিত রায়ের বাড়ি হিসেবে। ব্রুকসাইট বাংলোয় এখন রয়েছে একটি ঘরে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত শোওয়ার খাট ও আয়না, অন্য ঘরে হাল ফ্যাশনের সোফা সেট। আর ঢুকেই রবীন্দ্র প্রতিকৃতির পাশে শোভা পাচ্ছে ‘শেষের কবিতা’ বইখানি। দু’টো ঘর জুড়ে রয়েছে পীড়াদায়ক কিছু অয়েলপেন্টিং। অন্দরমহলের সাজসজ্জায় ঐতিহ্যের লেশমাত্র নেই। গড়ে দশ জন পর্যটক প্রতিদিন আসেন কিনা সন্দেহ। অন্তত ‘ভিজিটার্স বুক’ সেই কথাই বলছে। বাংলোর সামনে শোভা পাচ্ছে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠিত রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি। তবে মূল রাস্তা থেকে বাঁক নিয়ে বাংলোয় ঢোকার রাস্তায় পাইন গাছের সারি ‘শেষের কবিতা’-র শিলং-কে মনে করিয়ে দেয়। গেটের স্মৃতিফলকে রবীন্দ্রনাথের লেখা “বিপদে মোরে রক্ষা করো,/ এ নহে মোর প্রার্থনা,/ বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”
বেঙ্গালুরুর বাড়িতে ওঠার কয়েক দিনের মাথায় ব্রজেন্দ্রনাথ কবির কাছে শুনতে চেয়েছিলেন ‘শেষের কবিতা’-র গল্প। ফলে ‘যোগাযোগ’ ছেড়ে ‘শেষের কবিতা’ লেখার আগ্রহটা বেড়ে গিয়েছিল তাঁর। যেদিন লেখাটা শেষ হল, সেদিন ছিল ১৯২৮-এর ২৫ জুন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন আর চেঁচিয়ে আবৃত্তি করছেন। পরের দিন ব্রজেন্দ্রনাথকে পড়ে শোনাবেন বলে অসুস্থ শরীর নিয়ে তাঁর এই লেখা। সেই রাতে পাশের ঘরে দরজার আড়ালে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলেন নির্মলকুমারী মহলানবিশ। তিনি লিখেছেন, “এসেছিলাম রাত জেগে লেখার জন্যে ওঁকে ভর্ৎসনা করতে, কিন্তু পাছে আমার উপস্থিতিতে লেখার ব্যাঘাত ঘটে তাই প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।”
রাত তখন প্রায় চারটে। রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি শেষ করলেন—
“তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারই দান;
গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়
হে বন্ধু, বিদায়।”
লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধান, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy