প্রতীকী ছবি
কেন্দ্রীয় সরকারের নূতন শিক্ষা নীতিতে অনেক কথাই আছে, কেবল গৌরী সেনের কোনও হদিশ দেওয়া হয় নাই। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে যে নূতন উচ্চতায় তুলিবার বিবিধ প্রস্তাব নীতিপত্রে পরিবেশিত, তাহার টাকা কোথা হইতে আসিবে, বুঝ লোক যে জান সন্ধান। ব্যয়বৃদ্ধি কেন আবশ্যক, শিক্ষাকাঠামোর দুই প্রান্ত হইতে তাহার দুইটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। এক দিকে, প্রাক্-প্রাথমিক স্তরের শিশুদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে পরিকল্পনা এই শিক্ষা নীতির অন্যতম বৈপ্লবিক অঙ্গ, তাহার যথাযথ রূপায়ণ করিতে চাহিলে অঙ্গনওয়াড়ির বর্তমান পরিকাঠামোকে বহুগুণ প্রসারিত এবং সমৃদ্ধ করিতে হইবে, সম্ভবত সমগ্র আয়োজনটিকেই নূতন করিয়া সাজাইতে হইবে। অন্য দিকে, উচ্চশিক্ষার পরিসরে বহু-বিষয়মুখী প্রতিষ্ঠান এবং এক একটি প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার ছাত্রছাত্রীর পঠনপাঠনের রাজসূয় আয়োজনও সস্তায় হইবার নহে। শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি অবশ্যই দেওয়া হইয়াছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি হইতে বাস্তবের দূরত্ব অন্তত বাহান্ন বৎসর। বাহান্ন বৎসর আগে কোঠারি কমিশনের সুপারিশে বলা হইয়াছিল, সরকারি শিক্ষা-ব্যয় জাতীয় আয়ের অন্তত ৬ শতাংশ হওয়া আবশ্যক। এখনও সেই অনুপাত দূর অস্ত্। তদুপরি, স্তিমিত অর্থনীতি কোভিডের ধাক্কায় শুইয়া পড়িয়াছে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলিকে জিএসটি-র ক্ষতিপূরণের টাকা মিটাইতে পারিবে কি না, তাহা লইয়া গভীর সংশয়, এই অবস্থায় শিক্ষা-ব্যয় বিপুল অঙ্কে বাড়িবে?
এই কঠোর বাস্তব হইতেই উঠিয়া আসে একটি গভীরতর অনুমান। শিক্ষার আয়োজনে সরকারের ভূমিকা বাড়াইবার সংস্থান মিলিবে না, মিলাইবার চেষ্টাও হইবে না, সেই আয়োজন উত্তরোত্তর বেসরকারি হাতে সমর্পিত হইবে। সমস্ত স্তরেই বেসরকারি শিক্ষার অনুপাত গত দুই দশকে প্রচুর বাড়িয়াছে, সেই প্রক্রিয়া অতঃপর আরও ব্যাপক হইতে চলিয়াছে। তাহাতে নীতিগত ভাবে আপত্তি নাই— শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং পরিচালনা বাড়িলে ভালই। কিন্তু সমস্যা দুইটি। এক, ভারতের মতো দেশে বেসরকারি এবং বাণিজ্যিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সচ্ছল অভিভাবকের প্রয়োজন মিটাইতে পারে, এবং তাঁহারা সমাজে সংখ্যালঘু। বেসরকারি শিক্ষার খরচ যে হারে বাড়িতেছে এবং যে মাত্রায় পৌঁছাইয়াছে, তাহাতে রাজ্য সরকার হইতে আদালত অবধি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে খরচ নিয়ন্ত্রণের জন্য হস্তক্ষেপ করিতে হইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি স্কুলের সাম্প্রতিক ইতিহাসও এই সূত্রে স্মরণীয়। এই ধরনের সরকারি হস্তক্ষেপ কতটা বিধেয়, তাহা লইয়া তর্ক থাকিতে পারে, কিন্তু এই বিষয়ে তর্কের অবকাশ নাই যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের সন্তানদের শিক্ষার সুযোগ দিতে চাহিলে সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা অপরিহার্য।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি খরচের নহে, শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং চরিত্রের। শিক্ষার বেসরকারিকরণ স্বাভাবিক ভাবেই শিক্ষাকে ক্রমশ কেরিয়ারের প্রস্তুতিতে পরিণত করিবার দিকে ঠেলিয়া দেয়, যেমন দিয়া চলিয়াছে। ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা অর্জনের মধ্য দিয়া কর্মক্ষেত্রের উপযোগী হইয়া উঠিবার প্রয়োজন অনস্বীকার্য, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। কিন্তু তাহাই একমাত্র উদ্দেশ্য হইয়া উঠিলে শিক্ষা খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ থাকিয়া যায়। এক দিকে অবহেলিত হয় সেই সব বিষয়ের পড়াশোনা, যাহাদের ‘বাজারদর’ কম, অন্য দিকে সমস্ত বিষয়েই গভীর চর্চার পরিবর্তে গুরুত্ব পায় কাজ চালাইবার ‘শর্টকাট’। আশঙ্কাগুলি যে কল্পিত নহে, দুনিয়ার শিক্ষাবিদরা তাহা ক্রমাগত বলিয়া চলিয়াছেন। নূতন শিক্ষা নীতিতে বেসরকারি শিক্ষার যথেচ্ছ ব্যয়বৃদ্ধিতে লাগাম পরাইবার প্রস্তাব আছে। কিন্তু বিড়াল ক্রমশ আরও জাঁদরেল হইয়া উঠিলে তাহার গলায় ঘণ্টা বাঁধিবার কাজটি কঠিনতর হইবে না কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy