গত বৎসর অগস্ট মাসে কলিকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ জানাইয়াছিল, ডিয়ারনেস অ্যালাওয়েন্স (ডিএ) বা মহার্ঘ ভাতা রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ‘অধিকার’। সেই রায়ের প্রেক্ষিতেই সম্প্রতি স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল জানাইল, ক্রেতাপণ্য সূচক অনুসারে ছয় মাসের মধ্যে কর্মীদের ডিএ মিটাইয়া দিতে হইবে। ‘অধিকার’ শব্দটি গোলমেলে। মহামান্য আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা বজায় রাখিয়াও অধিকারের প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। সেই প্রশ্নের একাংশ প্রক্রিয়াগত, অন্য অংশ দার্শনিক। প্রথমত, কর্মী নিয়োগের সময় সরকার জানাইয়া দেয়, যখন যে রকম ভাতা দেওয়া হইবে, তাহাই কর্মীর প্রাপ্য। মহার্ঘ ভাতা পাইবার অধিকারটি সেই চুক্তিমতে স্বীকৃত কি না, তাহা অস্পষ্ট।
বস্তুত, এই বৎসর ফেব্রুয়ারি মাসে তামিলনাড়ু বিদ্যুৎ বোর্ডের একটি মামলায় দেশের শীর্ষ আদালত মন্তব্য করিয়াছিল যে মহার্ঘ ভাতা কর্মদাতার আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। অতএব, প্রশ্নটি লইয়া ভাবিবার অবকাশ আছে। কিন্তু, বৃহত্তর প্রশ্ন হইল, মহার্ঘ ভাতা (এবং অতি অবশ্যই পে কমিশন) প্রথায় কর্মীর কুশলতা ও কর্মদক্ষতা বিচারের কোনও অবকাশ নাই। ইহা অনস্বীকার্য যে চাকুরির ক্ষেত্রে পদোন্নতি ও বেতনবৃদ্ধি, এই দুইটি কর্মীদের নিকট দুই বৃহৎ প্রাপ্তি। নিজের কাজটি যথাযথ ভাবে করা এবং না করায় যদি এই প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনও তারতম্য না ঘটে, তবে আন্তরিক শুভচেতনা ভিন্ন আর কিসের তাগিদে কোনও সরকারি কর্মী কাজে মন দিবেন? শুভচেতনার উপর ভরসা করিয়া একটি ব্যবস্থা পরিচালনা করিলে কী ফল হয়, অধিকাংশ সরকারি দফতরই তাহার সাক্ষ্য দিবে। ফলে, দক্ষ এবং সৎ কর্মীদের স্বার্থেই পাইকারি হারে বেতনবৃদ্ধির প্রথাটি এই বার বর্জন করা বিধেয়। সমস্তরের সব কর্মীর সমান হারে বেতন বাড়াইবার বাধ্যবাধকতা নহে, দক্ষ কর্মীকে তাঁহার দক্ষতা ও পরিশ্রমের পুরস্কার দেওয়াই লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
এই পদ্ধতিগত প্রশ্নগুলিকে অতিক্রম করিলেও একটি বৃহত্তর দার্শনিক প্রশ্ন থাকে। বণ্টনের ন্যায্যতার প্রশ্ন। দেশের জনসংখ্যার একটি অতি সামান্য অংশই সরকারি চাকুরিতে নিযুক্ত। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব যেখানে সকলের উপর সমান ভাবে পড়ে, সেখানে তাহার মোকাবিলা করিতে মহার্ঘ ভাতা কেবল সরকারি কর্মীদেরই প্রাপ্য হইবে কেন? যাঁহারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, অথবা স্বনিযুক্ত, কৃষক, অথবা কোনও কারণে কর্মহীন, রাষ্ট্রের নিকট তাঁহাদের এই ভাতাটি প্রাপ্য নহে কেন? সত্য, দেশের অধিকাংশ মানুষই সরকারি চাকুরির ‘যোগ্য’ নহেন— তাঁহাদের সিংহভাগ এই চাকুরির পরীক্ষাটিই দিতে পারেন না। যাঁহারা পরীক্ষা অবধি পৌঁছান, তাঁহাদেরও সিংহভাগ সেই গণ্ডি অতিক্রম করিতে পারেন না। কিন্তু, যাঁহারা পারেন, তাঁহাদের ‘যোগ্যতা’টিও কি স্বোপার্জিত? সেই যোগ্যতার শিকড়েও কি দীর্ঘ ঐতিহাসিক বঞ্চনার ইতিহাস নাই— বর্ণ, বিত্ত, জন্মগত এবং অবস্থানগত সুবিধা, সব কিছুরই ভূমিকা নাই? যে ‘যোগ্যতা’ সর্বার্থে স্বোপার্জিত নহে, তাহার ভিত্তিতে বাড়তি সুবিধা দাবি করা কোনও বিচারেই ন্যায্য হইতে পারে কি? তাহা কি ‘অধিকার’ হিসাবে স্বীকৃত হইতে পারে? নিজেদের অবস্থানগত সুবিধার কথা ভুলিয়া সরকারি কর্মীরা কি এই বৃহত্তর ন্যায্যতার দাবির কথাটি ভাবিবেন? না কি, তাঁহারা ‘অধিকার’ আদায় করিলেই সন্তুষ্ট? ভারতীয় রাজনীতিও কি কথাটি ভাবিয়া দেখিবে?
রাজনীতির দুর্ভাগ্য, বণ্টনের ন্যায্যতার প্রশ্নটি কখনও কেন্দ্রীয় তর্ক হইয়া উঠিতে পারে না। অতীতেও পারে নাই। যখন রাজনীতিতে বণ্টনে ন্যায্যতার প্রশ্নটি সম্পূর্ণ ব্রাত্য ছিল না, তখনও রাষ্ট্র সরকারি কর্মীদের এই গোত্রের দাবিদাওয়ার অনৈতিকতার দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে নাই। এখন বা ভবিষ্যতে করিবে, তেমন ভরসাও নাই। বরং, অনেক গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠিবে ভোটের হিসাব, ‘কিছু দেওয়া’র বিনিময়ে ‘কিছু পাওয়া’র চাহিদা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy