Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

সুযোগ

ক্ষণে ক্ষণে, কারণে অকারণে অপ-কারণে, ‘ভারতমাতা কি জয়’-এর চিৎকৃত বিকৃত ধ্বনি শুনিয়া রাষ্ট্রের যে গরিমার ধারকাছও পৌঁছানো যায় না, অকস্মাৎ যেন সেই গরিমার আভা বহু দূর হইতে ইউএনজিএ-র আন্তর্জাতিক মঞ্চে আসিয়া পড়িল।

রাষ্ট্রপুঞ্জের ৭৪তম সাধারণ সভার মঞ্চে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি

রাষ্ট্রপুঞ্জের ৭৪তম সাধারণ সভার মঞ্চে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক শিকাগো-বক্তৃতা হইতে যখন কিছু শব্দবন্ধ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁহার সে দিনের উচ্চাশী ভাষণটিতে উদ্ধৃত করিলেন, রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে ‘ভারতমাতা’র সদাবিধ্বস্ত মুখটি যেন মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। ক্ষণে ক্ষণে, কারণে অকারণে অপ-কারণে, ‘ভারতমাতা কি জয়’-এর চিৎকৃত বিকৃত ধ্বনি শুনিয়া রাষ্ট্রের যে গরিমার ধারকাছও পৌঁছানো যায় না, অকস্মাৎ যেন সেই গরিমার আভা বহু দূর হইতে ইউএনজিএ-র আন্তর্জাতিক মঞ্চে আসিয়া পড়িল। সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ, এমনকি আঞ্চলিক স্বার্থও অতিক্রম করিয়া প্রধানমন্ত্রী সেখানে বিশ্বব্যাপী ঐক্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনটির কথা জোর দিয়া বলিলেন। অন্যান্য দেশের সহিত একত্রে মিলিয়া বিবিধ সমস্যার মোকাবিলার কথা বলিলেন। বহুপাক্ষিক বিদেশনীতির গুরুত্বের কথা বলিলেন। সন্ত্রাসভয়ে পীড়িত মানবসমাজকে কী ভাবে বিভিন্ন দেশের একত্র উদ্যোগে শান্তি ও স্থিতির দিকে লইয়া যাওয়া যায়, প্রযুক্তির উন্নতির মাধ্যমে কী ভাবে বহুপাক্ষিক শান্তির পথে অগ্রসর হওয়া যায়— এ সবের সন্ধান করিতে বলিলেন। ১৯৯৬ সালের ‘কম্প্রিহেনসিভ কনভেনশন অব ইন্টারন্যাশনাল টেররিজ়ম’ বা সিসিআইটি-র প্রতি নূতন করিয়া বিশ্ব-সমর্থন তৈরির আশা ব্যক্ত করিলেন। এই প্রথম বার নহে। তিন মাস আগে জাপানের ওসাকায় জি-২০ বৈঠকেও মোদী ‘রিফর্মড মাল্টিকালচারালিজ়ম’ বা সংশোধিত বহুসংস্কৃতিবাদের নীতির উপর জোর দিয়াছিলেন। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মঞ্চে এই ভাবেই ভারতের অবস্থানটিকে তিনি পুনর্ব্যাখ্যা করিতে চাহিতেছেন। এই পরিস্থিতিতে, ভারত যে বিশ্বকে যুদ্ধ দেয় নাই, বুদ্ধ দিয়াছে, এমন একটি আপাত-লঘু মন্তব্যও রীতিমতো মানাইয়া গেল। প্রচারের ভাষা, সন্দেহের অবকাশ নাই। তবু কূটনীতিতে প্রচারের ভাষা বা রেটরিক-এর মূল্যও তো কম নহে। সব মিলাইয়া, হিসাবের খাতায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই বারের রাষ্ট্রপুঞ্জ সফরকে তাঁহার বিদেশনীতির সাফল্যরূপে লেখা চলিতে পারে।

বিদেশনীতির সাফল্য সত্যই কতখানি গভীর, তাহার চুলচেরা বিচারের অবকাশ পরেও মিলিবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এ বারের সফরের পর তাঁহার প্রতি প্রত্যাশাটি এখনই বলা জরুরি। যে কথাগুলি তিনি বিদেশে দাঁড়াইয়া বলিয়া আসিলেন, এবং ন্যায্যতই উচ্চ প্রশংসিত হইলেন— দেশে ফিরিবার পর প্রায় মহাতারকার অভ্যর্থনা পাইলেন— তাহা তিনি এ বার দেশেও প্রচার করেন না কেন! গত সওয়া পাঁচ বৎসরে তাঁহার সরকারের বিরুদ্ধে বারংবার মতাদর্শগত সঙ্কীর্ণতা ও রাজনৈতিক একদেশদর্শিতার অভিযোগ উঠিয়াছে, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁহার বিরুদ্ধে সমালোচনার শেল বর্ষিত হইয়াছে যে, দেশের ঐক্যের বহু সঙ্কটসময়ে তিনি নীরবতার আশ্রয় লইয়া দায়িত্ব এড়াইয়া যান, এবং সঙ্কটসৃষ্টিকারী পক্ষকে নীরবতার মাধ্যমে প্রশ্রয় দেন। রাষ্ট্রনেতা হিসাবে বিদেশে প্রশংসা কুড়াইবার পর মোদী দেশেও নিজেকে ভিন্ন আলোকে তুলিয়া ধরিতে পারেন। স্বামীজির ওই ঐক্য ও শান্তির বাণী দেশেও প্রচার করিতে পারেন। এবং, নিজের দেশের রাজনীতিতে যে হেতু বক্তব্য উচ্চারণের পরও একটি বড় দায়িত্ব থাকিয়া যায়— বক্তব্যকে কাজে প্রতিফলিত করা— সে দিকেও মন দিতে পারেন। নতুবা সমালোচকরা আবারও বলিবেন যে, বাহিরে গিয়া কথার ফুলঝুরি ঝরাইলেই সত্যকারের ‘নেতা’ হওয়া যায় না। বলিবেন যে, বিমান হইতে দেশের মাটিতে অবতরণ মাত্রই যে পুষ্পশোভিত মঞ্চ তাঁহার জন্য তৈরি ছিল, সেইটির কথা ভাবিয়াই তিনি যাহা করিবার করিয়াছেন, দেশের রাজনীতির খাতিরেই বিদেশে গিয়া কূটনীতির সুবাক্য চয়ন করিয়াছেন। বাস্তবিক, নরেন্দ্র মোদীর কাছে ইহা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত: নিজের কূটনীতির সাফল্যের দর্পণে রাজনীতির অভিমুখটি আবার করিয়া নির্ধারণের সুযোগ।

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi UNGA
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy