স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে। —ফাইল চিত্র
পশ্চিমবঙ্গের সরকারি লেখ্যাগার থেকে প্রকাশিত তথ্যাবলিতে ১৯৪২ সালের আন্দোলনে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলি, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, রংপুর এমনকি, পার্শ্ববর্তী বর্ধমানের কথা জানা গেলেও, পুরুলিয়ার কথা কিছুটা যেন উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে। তা সে এখানকার জনজাতির ইতিহাসই হোক, বা ইংরেজ দমননীতির বিরুদ্ধে গণসংগ্রামে আত্মবলিদান। সেই সব ঘটনার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ এখনও আমাদের অধরা ও অজানা।
অথচ, এর অর্থ এই নয় যে, পুরুলিয়ায় ওই আন্দোলনের ভিত মজবুত ছিল না। বরং পুরুলিয়ায় গণ আন্দোলনের এবং বৃহত্তর অর্থে জঙ্গলমহলে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধারাবাহিকতা ছিল। তার উৎস নিহিত ছিল মানভূমের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে। যেখানে আপাত নিরীহ জনজাতি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল। সংগ্রামী চেতনা থেকে, ধর্মীয় জীবনবোধ থেকে, সত্য, ন্যায় ও আত্মমর্যাদা রক্ষার তাগিদ থেকে— তাঁরা ব্রিটিশদের বিরোধিতা করেন।
পাইক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহের যে প্রজ্জ্বলিত ঐতিহ্য, তা প্রমাণ করে এই আরণ্যক জনগোষ্ঠীর মনোবলকে কখনওই দমিয়ে রাখা যায়নি। হয়তো তার জন্য এই কৃষিজীবী গোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছে। কিন্তু জঙ্গলজমির অধিকার থেকে তাঁদের উৎখাত করা যায়নি। বীরের শিরোপা থেকে তাঁদের বিচ্যুত করা যায়নি।
এখানকার মানুষের এই রাজনৈতিক বোধ থেকেই ১৯৪২-এর অগস্ট আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মানভূমের অংশগ্রহণকে ফিরে দেখার এই প্রচেষ্টা। ইতিহাসবিদ সুমিত সরকার বলেছেন, ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে মধ্য শ্রেণির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মানভূমের ক্ষেত্রে একটু অন্য রকম চিত্রই লক্ষ্য করা যায়। থানাওয়াড়ি বিচার করতে গিয়ে, ভাবতে অবাক লাগে যে, মানভূমের প্রান্তবর্তী শ্বাপদসঙ্কুল, প্রায় বিচ্ছিন্ন এলাকা বান্দোয়ানের শতাধিক নিরক্ষর, নিতান্তই সাদামাটা কৃষিজীবী মানুষ সে দিন কী উৎসাহেই না থানা ঘেরাও অভিযানে শামিল হয়েছিলেন!
মেদিনীপুরের তমলুকে মাতঙ্গিনী হাজরার আত্মবলিদানের কথা সবাই জানি। কিন্তু তাঁর পরদিনই ২৯ সেপ্টেম্বর বিয়াল্লিশের আন্দোলনের অভিঘাতে শহিদ হয়েছিলেন মানভূমের গোবিন্দ মাহাতো ও চিনারাম মাহাতো। গুরুতর আহতদের মধ্যে যাঁদের নাম আমরা পাই, তাঁর মধ্যে সর্বাগ্রে স্মরণীয় ও বরণীয় গিরীশচন্দ্র মাহাতো এবং হেমচন্দ্র মাহাতো। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে যেমন ‘বাংলার বাঘ’ বলা হত, তেমনই ‘মানভূমের বাঘ’ বলা হত অকুতোভয় হেমচন্দ্র মাহাতোকে। মানভূম থানা ঘেরাও-এর উপক্রম হলে উপয়ান্তর না দেখে পুলিশ যখন জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়, তখন মিছিলের পুরোভাগে থাকা হেমচন্দ্রের গায়ে গুলি লাগে। সেই থেকে মানভূমের লোকমুখে তাঁর সম্পর্কে প্রবাদ চালু হয়েছিল ‘মানভূমের বাঘ/ গায়ে গুলির দাগ।’
শুধু বান্দোয়ান বা মানবাজারই নয়, অগস্ট আন্দোলনে মানভূমের সাধারণ মানুষের অসমসাহসী ভূমিকার বিবরণ আমরা পাই বরাবাজার ও পুঞ্চা থানা অঞ্চলে। পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা থেকে সে সময় বিশাল একটি মিছিল তাঁদের পদযাত্রা শুরু করে কলকাতার উদ্দেশে। এ থেকে বোঝা যায় মানভূমের নির্ভীক প্রতিবাদী যে আন্দোলন তার মধ্যে ভূমিজ, কৃষিজীবী মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকলেও রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে কলকাতার সঙ্গে তার যোগসূত্র ছিল অব্যাহত।
মানভূমে অগস্ট আন্দোলনের যে পর্যালোচনা তা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, যদি আমরা এআইসিসি’র বোম্বাই অধিবেশন প্রত্যাগত অতুলচন্দ্র ঘোষের নাম না করি। পুলিশ কালবিলম্ব না করে ১৩ অগস্ট তাঁকে গ্রেফতার করলে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে উঠেছিল। আন্দোলনে পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমের নেতৃবৃন্দের বিশেষত বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণ ঘোষ, বৈদ্যনাথ দত্ত, রামকিঙ্কর মাহাতোর ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তবে এই আন্দোলনের আগুনকে পুলিশি ধরপাকড় দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে আন্দোলন এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল, যে প্রশাসন থেকে কার্ফু জারি করে সড়ক ও রেলপথ সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল।
মানভূমে অগস্ট আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার আরও দু’টি কারণ ছিল। এক দিকে, আন্দোলনকারীরা স্থানীয় মারোয়াড়ি অ্যাসোসিয়েশনের সমর্থন লাভে সমর্থ হয়েছিলেন, অন্য দিকে, ‘মুক্তি’ ও ‘কল্যাণে’র মতো ছোট ছোট স্থানীয় পত্রিকাগুলিও নির্ভীক সাংবাদিকতার ছাপ রেখেছিল।
মানভূমে অগস্ট আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির যে ধারা, তা থেকে এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, আন্দোলনের তীব্রতা উত্তরের তুলনায় দক্ষিণ পুরুলিয়াতেই বেশি ছিল। তবে জেলার উত্তর প্রান্তে আদ্রা, রঘুনাথপুর, হুড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও অনেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ধর্মঘটে শামিল হয়েছিলেন। পুরুলিয়ায় এই আন্দোলনের উজ্জ্বলতম দিক হল মানভূমের ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের ছাত্রদের অভূতপূর্ব উৎসাহী যোগদান, যা এই আন্দোলনকে বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্র তথা শিক্ষিত সমাজ সার্বিক ভাবেই বিয়াল্লিশের আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সেই আদর্শই আগামী দিনে স্বাধীন ভারত গঠনের প্রধান চালিকাশক্তিতে পর্যবসিত হয়েছিল।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: দিলীপকুমার গোস্বামী, অর্ণবী সেন
লেখক ইতিহাসের শিক্ষক, সিটি কলেজ, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy