শাহিনবাগ আর আমাদের কাছে অচেনা নয়। অচেনা নয় রেহানা খাতুনের ২৩ দিনের কন্যাসন্তানকে নিয়ে দিল্লির ঠান্ডায় খোলা আকাশের নীচে প্রতিবাদ, অথবা ৯১ বছরের বিলকিসের বলিরেখা চিহ্নিত গল্প।
কাগজে আর সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা এগুলো দেখছি, দু’একটা সহানুভূতিবাচক শব্দ করছি এবং যে কথাটা বলব কি বলব না ভাবছি, তা হল: প্রতিবাদটা মেয়েদের। আর শুধু মেয়েদের নয়, ‘ওদের’ মেয়েদের। প্রতিবাদের জায়গা, প্রতিবাদের নাম, প্রতিবাদের হিজাব সবই একই কথা বলছে— ওদের সমস্যা, ওদের প্রতিবাদ, ওদের কালিন্দিকুঞ্জ, ওদের শাহিনবাগ, ওদের রেহানা খাতুন, ওদের বিলকিস।
‘এত টাকা কোথা থেকে আসছে— দুবাই নাকি?’ ‘তেলের টাকা পিছনে আছে?’ ‘আরে টাকা না থাকলে এত বিরিয়ানি খাওয়াচ্ছে কী করে?’ ‘ক্রাউড ফান্ডিং-টান্ডিং লোক দেখানো, সারা পৃথিবীতে তো ওদের লোক ছড়ানো, সেখান থেকেই টাকা আসছে...’
কোথা থেকে আসছে টাকা? কারা আছে শাহিনবাগের পিছনে? সবাই, সব্বাই কি ‘ওদের’ লোক? শাহিনবাগ জায়গাটা দিল্লির কালিন্দিকুঞ্জ মেট্রো স্টেশনের কাছে। কালিন্দিকুঞ্জ সংলগ্ন দক্ষিণ দিল্লির ওখলা অঞ্চলটি মূলত সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হলেও, হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশও কম নয়। যেমন কম নয় শাহিনবাগের জমায়েতে হিন্দুদের অংশও। এই প্রতিবাদের যাবতীয় টাকাপয়সার লেনদেন সামলানোর গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন সিদ্ধার্থ সাক্সেনা এবং তাঁর বন্ধুরা, যাঁরা সকলেই হিন্দু। শাহিনবাগের মহিলাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে আছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা, যাঁরা অধিকাংশই ‘ওদের’ ধর্মের অংশ নয়।
শাহিনবাগের মধ্যে যেমন অন্য শাহিনবাগ, সারা দেশেও ছড়িয়ে আছে শাহিনবাগেরা। অন্ধ্রপ্রদেশের দূরত্ব উত্তর ভারতের শাহিনবাগের থেকে কিলোমিটারে অনেকখানি। সংখ্যালঘু রাজনীতির দাপট, আসাদুদ্দিন ওয়াইসির ‘এআইএমআইএম’-এর দাপট সেখানে কম নয়। তবু অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইসির ডাক ছাড়াই সংগঠিত হয় অসংখ্য মানুষের পদযাত্রা— কখনও কোলারে, কখনও কুরনুলে।
চেন্নাইতে আলপনার মুখ নেয় শাহিনবাগ। কোলাম বা সাদা আলপনার এক বিশেষ পদ্ধতি চেন্নাইয়ের ট্র্যাডিশন। বছরের শেষ সপ্তাহে খুব ভোরে দেখা যায়, শহরের একাংশের রাস্তায় সারা রাত জুড়ে আঁকা কোলামের নকশায় ফুটে উঠেছে প্রতিবাদ। সরকার জমায়েতের অনুমতি দেয়নি, তাই এই পথ। তাও এই আঁকার জন্য জেলে যেতে হয়েছে পাঁচ হিন্দু মহিলাকে। হিন্দু ধর্মের আলপনায় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের মুখ, অন্য শাহিনবাগ।
যেমন মুম্বইয়ের অগস্ট ক্রান্তি ময়দানের জমায়েত। ১৯ ডিসেম্বর, কয়েক হাজার মানুষ জড়ো হন ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণের ঐতিহাসিক স্থানে। জমায়েতে অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালকেরাও ছিলেন, সংগঠক ছিল মুম্বইয়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োর মানুষ। কোনও ধর্ম, পদবির বোঝা ছাড়াই। ছিলেন জি জি পারেখ, যিনি গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তাব গ্রহণের দিনও ছিলেন সেই ময়দানে। তাঁর ধর্ম কী, প্রশ্ন করবেন কি কেউ?
আর অবশ্যই আছে ছাত্রছাত্রীরা। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় না-হয় ‘ওদের’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিন্তু আইআইএম, আইআইটি কানপুর, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়? হালকা, কেরিয়ারমনস্ক প্রজন্ম বলে যাদের দেগে দেওয়া হয়েছিল, তারা সাহস দেখাচ্ছে, না-চেনা সহপড়ুয়ার পাশে দাঁড়াচ্ছে কেরিয়ারে পুলিশি ছাপের তোয়াক্কা না করে।
বছরের শুরুতেই, ৫ জানুয়ারি হায়দরাবাদে দশ লাখ মানুষ রাস্তায় নামল ‘মিলিয়ান্স মার্চ’-এ। কোনও রাজনৈতিক, ধর্মীয় সংগঠনের পতাকা ছাড়াই। দশ লাখ মানুষের ধর্মপরিচয় জানতে চান কেউ?
একই দিনে বেঙ্গালুরু দেখল ‘বোরখা আর বিন্দির প্রতিবাদ’। পোশাক দেখলেই চিনে নেওয়ার নিদানকে অগ্রাহ্য করে শুধু মহিলাদের দ্বারা আয়োজিত এই প্রতিবাদ।
বেঙ্গালুরুতেই ২৬ ডিসেম্বর হঠাৎই আক্রমণ নামে জমায়েত হওয়া পুরুষ প্রতিবাদীদের উপর। প্রতিবাদীরা অনেকেই এ ক্ষেত্রে ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বাঁচাতে তৎক্ষণাৎ মানব-বন্ধন তৈরি করেন মহিলারা, যাঁরা অধিকাংশই হিন্দু। যেমন আমরা সবাই দেখেছিলাম ভাইরাল হওয়া দৃশ্যে, নমাজ পাঠরত বন্ধুদের পাহারা দিচ্ছে মানব-বন্ধনে শিখ, হিন্দু সহপাঠীরা।
অন্য শাহিনবাগ নয়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy