Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

কমছে চারণভূমি-গবাদিপশু, সঙ্কটে ‘বাগাল’দের অস্তিত্ব

‘রাখাল’ বলতেই মানসচক্ষে ভেসে ওঠে কোনও এক দুপুরে একটানা বাঁশির সুর। কিন্তু বাস্তবের রাখালজীবন রোমান্টিক নয়। ঋতু, কাল, স্থানভেদে সেখানে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম আর দারিদ্র। লিখছেন পার্থসারথি গোস্বামীএই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাগালেরা গরু বাছুরের দেখভাল করে এলেও, মজুরি কিন্তু এমন কিছু পান না। আগে গরু-বাছুর প্রতি, প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান দেওয়া হত বাগালদের।

গরুর পাল, সঙ্গে ‘বাগাল’। মানবাজার ২ ব্লকের ডোমজুড়ি গ্রামে। —নিজস্ব চিত্র

গরুর পাল, সঙ্গে ‘বাগাল’। মানবাজার ২ ব্লকের ডোমজুড়ি গ্রামে। —নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

‘গুপি-বাঘা ফিরে এল’র সেই গানটা— ‘কেমন বাঁশি বাজায় শোনো, মাঠেতে রাখাল’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘দূর দেশী সেই রাখাল ছেলে—’

‘রাখাল’ বলতেই অনেকের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে কোনও এক দুপুরে একটানা বাঁশির সুর। কিন্তু বাস্তবের রাখালজীবন রোমান্টিক নয়। ঋতু, কাল, স্থানভেদে সেখানে রয়েছে কঠোর পরিশ্রম আর দুঃসহ দারিদ্র।

বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার বেশিরভাগ গ্রামের প্রভাতকালীন দৃশ্যটি মোটামুটি একই রকম। প্রত্যেক বাড়ি থেকে হয় নিজেরা, নয় বাড়ির কাজের লোক, হাতে একটি লাঠি নিয়ে তদারকি করতে করতে বাড়ির গোয়াল থেকে গরু-বাছুরের দলকে নিয়ে চলেছেন বাথানের উদ্দেশে। গ্রামের কোনও এক প্রান্তে মোটামুটি অকৃষিযোগ্য এক ভূখণ্ডে (‌বে‌শিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও ‘তড়া’ জমিতে)। সেই বাথানে সকল গবাদি পশুর দিনভরের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় যাঁর হাতে, তিনিই ‘বাগাল’। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার রাখাল। লোককথা আছে, শ্রীকৃষ্ণ এক দিন গরু চরাতে চরাতে ক্লান্ত হয়ে কোনও এক গাছের ছায়ায় বসে নিজের গায়ের ময়লা থেকে সৃষ্টি করেছিলেন এই বাগালদের। গরু চরানোই হল বাগালের পেশা।

আপাতদৃষ্টিতে গরু চরানো সহজ মনে হলেও, আদতে তা কিন্তু নয়। গরু চরানোর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত দিন পালের প্রতিটি গরু-বাছুরের সমস্ত দায়িত্ব থাকে বাগালের উপরে। গ্রামে গ্রামে মোটামুটি গ্রাম্য ষোলোআনা থেকেই ‘বাগাল’ নির্বাচন করা হয়। তা ছাড়া, কোনও কোনও গ্রামে বংশ-পরম্পরায় এই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন কোনও কোনও পরিবার। সকালে বাথানের স্থানে গরু-বাছুরদের পৌঁছে দিয়ে আসার পর থেকে সূর্যাস্তের পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে গরু-বাছুরদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব হল বাগালের। প্রবল দায়িত্ব ও বিশ্বাসযোগ্যতাও জড়িত এই পেশার সঙ্গে। বাথানে সকলের গরু-বাছুর পৌঁছে গেলে গরুর দলকে সমস্ত দিন ধরে নানা চারণভূমিতে নিয়ে ঘুরতে থাকেন বাগাল। নির্দিষ্ট সময়ে আবার পশুগুলিকে জল খাওয়ানোর জন্য নিয়ে পৌঁছে যেতে হয় কোনও জলাশয়ে, জল খাওয়ানোর পরে আবার ফেরত নিয়ে যেতে হয় চারণভূমিতে।

এ ভাবেই সারাটি বছরের প্রতিটি দিন, রোদ বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে গরু চরান বাগাল। ঢিলেমির কোনও জায়গাই নেই, সমস্ত দিন পালের প্রতিটি পশুর উপরে রাখতে হয় সজাগ দৃষ্টি, পাল থেকে কোনও গরু-বাছুর যদি কোনও ভাবে হারিয়ে যায় সে খেসারত দিতে হয় বাগালকেই, এমনকি, পালের কোনও পশু যদি কারও জমিতে নেমে ফসল নষ্ট করে, তা হলেও বাগালকেই দিতে হয় জরিমানা। যন্ত্রণার জায়গা আরও আছে। সমস্ত দিন রোদে পুড়ে, জলে ভিজে গরু চরিয়ে বাড়ি ফেরার পর যখন এসে কেউ অভিযোগ জানায় যে, কারও গরু গোয়ালে ফেরেনি, তখন একটু বিশ্রাম তো দূর, আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ঘুরে বেড়াতে হয় সেই নিখোঁজ গরু বা বাছুরের জন্য।

এই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে বাগালেরা গরু বাছুরের দেখভাল করে এলেও, মজুরি কিন্তু এমন কিছু পান না। আগে গরু-বাছুর প্রতি, প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ধান দেওয়া হত বাগালদের। বাগালের স্ত্রী গ্রাম ঘুরে ঘুরে সেই ধান সংগ্রহ করতেন। তা ছাড়া, একটি অলিখিত নিয়মও প্রচলিত অনেক জায়গায়। গোয়াল পুজো, বাঁদনা, বিজয়া প্রভৃতি নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে বাগাল বা বাগালের বউ যেতেন গ্রামের ঘরে ঘরে, প্রত্যেক বাড়ি থেকে তাঁরা সংগ্রহ করতেন গুড়-পিঠে, মিষ্টি, মুড়ি, মুড়কি প্রভৃতি খাদ্যসামগ্রী। বর্তমানে সেই প্রথাটি অপরিবর্তিত থাকলেও ধানের বদলে এখন গরু-বাছুর প্রতি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়ার নিয়ম শুরু হয়েছে। এ ছাড়া, পাল থেকে সংগৃহীত গোবর বা ঘুঁটে বিক্রি করেও একটা উপার্জন হয়, কিন্তু এখন বাড়িতে বাড়িতে দিন দিন গ্যাসে রান্না করার প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায়, ঘুঁটের সে চাহিদা আর নেই।

ব্রজরাজপুর গ্রামের বাগাল বারু বাউরির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, বর্তমানে এই পেশা সঙ্কটের মুখে। দিন-দিন কমে আসছে গবাদি পশুর সংখ্যা। আগে গ্রামের প্রতি ঘরে অন্তত পাঁচ-দশটি করে গরু বাছুর থাকত। এখন অধিকাংশ পরিবারই দেখভালের ঝামেলার জন্য পশুপালন বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে, পালে পশুর সংখ্যা কমে আসছে। এখন প্রতি গরু বা বাছুর প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৬০ টাকা করে ধার্য করা আছে। পালে মোট গরু-বাছুরের সংখ্যা মোটামুটি ১৫০। বারু বাউরি বলেন, ‘‘আগে আমার পালে প্রচুর গরু-বাছুর ছিল, মাসে মাসে যে ধান পেতাম, তা থেকে সারা বছরের ভাতের চাল থেকে শুরু করে আমার সংসার হেসেখেলে চলে যেত। কিন্তু এখন মাস পোহালে যে টাকা পাই, সংসার চালানো মুশকিল হয়ে যায়। তা ছাড়া, সব টাকা এক সঙ্গে হাতে পর্যন্ত আসে না। তবে গ্রামের মানুষের সাহায্য ও সহযোগিতা না পেলে বছরের পরে বছর এই পেশায় টিকে থাকতে পারতাম না।’’

বারু বাউরি এখন বয়সের ভারে একা এত ঝক্কি নিতে পারেন না। তাই তাঁকে সাহায্য করার জন্য পেশায় যোগ দিয়েছেন তাঁর ছেলে গুরুপদ বাউরি ও তাঁর স্ত্রী। গুরুপদর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিন দিন চারণভূমির পরিমাণও কমে আসছে। মোটামুটি ভাবে চাষে অব্যবহৃত ‘তড়া’ জমিই বেছে নেওয়া হতো গরু চরানোর জন্য। আগে গ্রামের আশেপাশে সে সব জমি ছিল। কিন্তু বর্তমানে কেউ জমি ফেলে রাখতে চায় না। পতিত জমিতে গড়ে ওঠে পোলট্রি ফার্ম, ইটভাটা ইত্যাদি। তাই সারাদিন গরুর চরানোর মতো জায়গাই পাওয়া যায় না বলে আক্ষেপ গুরুপদর। গ্রাম থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে নদীর চর পর্যন্ত পৌঁছে যেতে হয় পাল নিয়ে। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি হয় জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ থেকে একেবারে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত। কারণ, এই সময়টা ধান চাষের সময়। এই সময় গরু-বাছুরদের সামলানো কঠিন হয়ে যায়। নজর এড়িয়ে কোনও ফসলের জমিতে গরু-বাছুর নেমে পড়লেই ঘাড়ের উপরে ঝুলবে জরিমানার খাঁড়া। বারু, গুরুপদরা জানেন না, এ ভাবে আর কতদিন!

লেখক বাঁকুড়ার সাহিত্যকর্মী

অন্য বিষয়গুলি:

Cowboy Cattle
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy