আক্রমণ হল আত্মরক্ষার সর্বোত্তম পন্থা। প্রচলিত এই প্রবচনটি রাজ্যের প্রাক্নির্বাচনী আবহে অর্থবহ হয়ে উঠছে। যার সাম্প্রতিক উদাহরণ, এখানে ভোটের আগে সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির প্রচ্ছন্ন হুমকি। খোদ রাজ্যপাল এই বিষয়ে কতটা আগ্রহী এবং সক্রিয়, তা-ও ইতিমধ্যে বেশ স্পষ্ট। বাকিটা নির্ভেজাল রাজনীতি!
রাজ্য বিজেপি এবং তাদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশের অভিমত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় রেখে ভোট হলে তারা সুবিধা করতে পারবে না। তাই কিছু দিন আগেও যে বিজেপি নেতারা গণতন্ত্রের জয়গান গাইতেন এবং সরাসরি জনতার রায়ে মমতাকে তুড়ি মেরে ক্ষমতাচ্যুত করার দাবি করতেন, তাঁরাই এখন আবার রাষ্ট্রপতির শাসন জারির পক্ষে ইনিয়েবিনিয়ে সওয়াল শুরু করে দিয়েছেন। অমিত শাহও বলেছেন, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপির এই দাবি যুক্তিসঙ্গত।
সবাই জানেন, কোনও রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি, অর্থাৎ সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ অতি সংবেদনশীল একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনাও থাকে। ফলে কেন্দ্র কোনও রাজ্যে ৩৫৬ ধারা জারি করতে চাইলেও অনেক সময় শেষরক্ষা কঠিন হয়ে পড়ে।
বাংলায় এ বারের নির্বাচনে বিজেপি যে তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নানা ভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করবে, সেই অনুমান অমূলক নয়। যেমন, ভোট এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে। দুর্নীতির তদন্ত করা, অভিযুক্তকে আইনানুগ সাজা দেওয়া, সবই উচিত কাজ। কিন্তু লক্ষণীয় হল, বেশ কিছু দিন এই সব তৎপরতা স্তিমিত ছিল।
শুধু তা-ই নয়, তৃণমূলে থাকার সময় থেকে যে নেতাকে নারদ-কাণ্ডে তদন্তের আওতায় রাখা হয়েছিল, বিজেপিতে পদাধিকারী হওয়ার পরে তাঁকে ‘ছাড়’ দেওয়ার উদ্যোগও নজর এড়ায় না। সাধারণ বুদ্ধিতে এরও ব্যাখ্যা পাওয়া কঠিন।
ঘটনাচক্রে বছরখানেক আগে বিজেপির ওই নেতাই এক দিন কথায় কথায় বলেছিলেন, ভোটের ছ’মাস আগে থেকে অনেক কিছু বোঝা যাবে! সেই ‘বোঝা’র সময় এগিয়ে এসেছে। প্রথমত দেখার, পুলিশ-আমলাদের সরানো। গত লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে এবং ভোট চলাকালীন পুলিশ ও প্রশাসনের বহু পদস্থ কর্তাকে নির্বাচন কমিশন সরিয়ে দিয়েছিল। অতীতে অবশ্য এমন আরও হয়েছে। পুনরাবৃত্তি হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
তবে এ বার অনেক বড় আলোচ্য রাষ্ট্রপতির শাসন জারি। আর এই সূত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হল রাজ্যপালের ভূমিকা। কয়েক মাস আগে লিখেছিলাম, রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় ভোটের সময় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠবেন। সেই কাজে তিনি নেমে পড়েছেন! ৩৫৬ জারির জল্পনা উস্কে দেওয়ার পিছনেও তাঁর ‘অবদান’ নেহাত কম নয়।
সবাই জানেন, ধনখড়ের আমলে রাজভবনের সঙ্গে সরকারের বিরোধ তিক্ততার যে স্তরে পৌঁছেছে, তা কলতলার ঝগড়াকেও হার মানায়। উভয়ের সম্পর্ক এখন আক্ষরিক অর্থে অহি-নকুল। আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি আছে দু’তরফেই। তবে দৃশ্যত রাজ্যপাল নিত্যদিন এমন কিছু করেন এবং বলেন, যা তাঁর পদমর্যাদার পক্ষে বেমানান। কোনও পূর্বসূরির কার্যকলাপের সঙ্গেও জগদীপ ধনখড়ের এই সব কমর্ধারার মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
রাজ্যপাল মনে করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার চরম অগণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট, হিংসাশ্রয়ী, দুর্নীতিপরায়ণ, সংখ্যালঘু-তোষণকারী, সাধারণ মানুষের স্বার্থবিরোধী ইত্যাদি। তাঁর এই মনের কথা তিনি প্রকাশ্যে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রায় রোজই উগরে দেন। যার ‘প্রসাদ’ পায় বিজেপি। রাজ্যপাল পদে তাঁর বছর দেড়েকের অভিজ্ঞতায় বিজেপির কোনও স্খলন-পতন-ত্রুটি অবশ্য ধনখড়ের ‘নিরপেক্ষ’ নজরে ধরা পড়েনি!
তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং দীর্ঘলালিত রাজনৈতিক ভাবনা অনুযায়ী হয়তো এটাই স্বাভাবিক। ফলে, কলকাতার রাজভবন থেকে দিল্লির নর্থ ব্লকে অমিত শাহের দফতরে নিয়মমাফিক যে রিপোর্ট পাঠানো হয়, তা-ও সহজবোধ্য কারণে রাজ্য সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক পর্যবেক্ষণে ঠাসা থাকে। কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ওই সব রিপোর্টের ‘গুরুত্ব’ অনেক। সেই জন্য কোনও রাজ্যপাল ক্রমাগত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে বলতে থাকলে চাপ তৈরি হয়।
সবাই জানেন, রাষ্ট্রপতির শাসন মানে রাজ্যপালের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়া। পুলিশ, প্রশাসন সবই তখন কাজ করে প্রকৃতপক্ষে রাজভবনের তত্ত্বাবধানে। পুলিশ, আমলা সকলে তখন রাজ্যপালকেই ‘সুপার বস’ মেনে চলতে বাধ্য থাকেন। জগদীপ ধনখড়ের মনোবাসনা সেটাই!
তাঁর বহু দিন ধরে পুঞ্জীভূত ক্ষোভের একটি বড় কারণ, রাজ্যের আইএএস, আইপিএস-রা রাজ্যপালের ‘হুকুম’ শোনেন না। তাঁরা নবান্নের প্রতি ‘অনুগত’। এ নিয়ে নিয়মিত ক্ষোভও প্রকাশ করেন তিনি। ৩৫৬ ধারা জারি হলে সেই পরিস্থিতি থাকে না। ধনখড়ের এটাই কাঙ্ক্ষিত, বলা চলে।
কিন্তু প্রশ্ন হল, নির্বাচিত সরকারের এক্তিয়ার থেকে প্রশাসন রাজভবনের কর্তৃত্বে চলে গেলেই কি সব কিছু ‘নিরপেক্ষ’ হয়ে যেতে পারে? রাজ্যপালরা কেন্দ্রের বশংবদ প্রতিনিধি। রাষ্ট্রপতির দ্বারা মনোনীত সংজ্ঞাটি নিছক ভাবের ঘরে চুরি। কেন্দ্রের শাসকদের স্বার্থে রাজ্যপালদের কী ভাবে ব্যবহার করা হয়, তাঁরাও কী ভাবে নিজেদের পদমর্যাদাকে ‘সঁপে’ দেন এবং বহু ক্ষেত্রে তা করতে গিয়ে হোঁচট খান, সে সব আজ নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশ জুড়ে অজস্র দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। নরেন্দ্র মোদীর জমানায় তো বটেই।
তাই রাষ্ট্রপতির স্বীকৃত প্রতিনিধি হিসেবে রাজ্যপালের হাতে শাসনক্ষমতা গেলে বকলমে যাঁরা চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন, তাঁদের হঠাৎ ‘নিরপেক্ষ’ ধরে নেওয়ার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। এটা বরং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ঘুরপথে ক্ষমতা দখলের ‘সাংবিধানিক’ কৌশল বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে। তাই কোনও চরম পরিস্থিতি বা সরকারের অস্তিত্বের যথার্থ সঙ্কট ছাড়া মানুষ সচরাচর ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ মেনে নিতে পারে না। প্রতিক্রিয়া হয় বিরূপ ও তীব্র। ভোটের ফলেও যার প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। তবু বাংলায় ভোটের আগে রাষ্ট্রপতির শাসনের চর্চা সামনে আনছে বিজেপি।
এই রাজ্যে এ পর্যন্ত চার বার ৩৫৬ জারি হয়েছে। প্রথম বার ১৯৬২-তে, মাত্র সাত দিনের জন্য। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পরে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী স্থির হওয়ার অন্তর্বর্তী সময়ে। বাকি তিন বারই তা ছিল দীর্ঘমেয়াদি। ১৯৬৮-তে ৩৭০ দিন, ১৯৭০ সালে ৩৭৯ দিন এবং ১৯৭১-এ ২৬৫ দিন।
ওই তিন বারই মূল কারণ ছিল বিধানসভায় সরকারের গরিষ্ঠতার সঙ্কট। আর তা তৈরি হয়েছিল শাসক গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ গোলমালে। বাইরে থেকে বিভিন্ন দল এবং তৎকালীন রাজ্যপালরা কলকাঠি নেড়েছিলেন ঠিকই, তবে প্রকাশ্যে বিষয়টি ছিল বিধানসভায় সরকারপক্ষ সংখ্যালঘু হয়ে যাওয়া।
কিন্তু এ বার যে কৌশল অবলম্বনের আঁচ মিলছে, সেটা সরকারের ভিতর থেকে উদ্ভূত সমস্যা নয়, বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া। সেখানে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এবং রাজ্যপাল ধনখড় এক-সুর। অন্য দুই বিরোধীপক্ষ কংগ্রেস ও বামেরা শাসক তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে সরব হলেও রাজ্যে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির মতো গুরুতর পরিস্থিতি হয়েছে বলে মনে করে না। মোদী-শাহ ৩৫৬-র পথে হাঁটলে বুঝতে হবে বঙ্গ বিজেপি সোজা ব্যাটে খেলতে অপারগ। জনতা নয়, তাদের ভরসাস্থল দিল্লির ক্ষমতা!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy