বিজ্ঞানচর্চায় ‘নকল হইতে সাবধান’ থাকার জন্য ২০১৫ সাল থেকে রীতিমতো কড়াকড়ি করছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। প্রতিটি গবেষণাপত্র ‘অ্যান্টি-প্লেজিয়ারিজ়ম’ সফটওয়্যার দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাই অন্যের থেকে টুকে থাকলে ডিজিটাল পদ্ধতিতেই তা ধরা পড়ছে। গবেষণার কাজ থেকে অন্তত একটি গবেষণাপত্র উচ্চমানের কোনও বিজ্ঞানের জার্নালে প্রকাশ করলে তবেই গবেষণাটি পিএইচ ডি ডিগ্রির জন্য বিবেচিত হওয়ার প্রথম ধাপ পেরোয়। এ ছাড়া নিজের ও বাইরের প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞদের কাছে পরীক্ষা তো আছেই।
আক্ষেপ, নিয়মের এমন বজ্র-আঁটুনিও বিজ্ঞানে উচ্চমানের মৌলিক গবেষণা নিশ্চিত করতে পারছে না। ফস্কা গেরো কম নয়। গবেষণাপত্র ছাপানোর জার্নাল আজ অগুনতি, কিন্তু অনেকগুলির মান সন্দেহজনক। কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে ব্যবসাও শুরু করেছেন। জার্নালটি নিউ ইয়র্ক বা প্যারিস থেকে প্রকাশিত, এমন লেখা থাকলেও আসলে তা বেরোচ্ছে মুম্বই কিংবা হায়দরাবাদ থেকে। গত বছর ইউজিসি তার অনুমোদিত জার্নালের তালিকা থেকে চার হাজারেরও বেশি জার্নাল বাদ দিয়েছে। আরও কয়েকশো জার্নাল ‘সন্দেহজনক’ তালিকায় আছে।
আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেও গবেষণাপত্র ছাপার এত রমরমা ছিল না। কে কেমন কাজ করছে, তা বুঝতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বা গবেষণাকেন্দ্রে বিজ্ঞানের আলোচনায় সবাই অংশ নিতেন। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় ও দক্ষতার আদানপ্রদান চলত। এখন শুধুই পেপার ছাপা ও গোনা চলছে। এর ফলে বহু দিন ধরে বহু কষ্টে গড়া ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার পাকাপোক্ত ও সাবধানী গবেষণার ঘরানাটি নষ্ট হতে বসার উপক্রম।
এত সাবধানতা সত্ত্বেও মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণায় তাক-লাগানো আবিষ্কার ইদানীং হয়নি। ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনও সচিন বা সৌরভ গত পঞ্চাশ বছরে পাওয়া যায়নি। সারা বিশ্বের দিকে তাকালেও বিজ্ঞানের জগতে গত পাঁচ দশকে যেন ভাটার টান। বছর কয়েক আগে কলকাতার একটি গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীদের সামনে এক অনুদান সংস্থার কর্তা বলেছিলেন, মৌলিক গবেষণা করলে উৎকর্ষই একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। নইলে এমন প্রকল্পে কাজ করাই ভাল যার ফল মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। তা-ই হচ্ছে। গড়পড়তা বিজ্ঞানীরা ঝুঁকছেন প্রযুক্তি ও কৌশলগত বিজ্ঞানের দিকে। শুধু কৌতূহল উদ্রেককারী সমস্যার উত্তর খোঁজার জন্য অনুদান মিলছে না কোনও দেশেই। বিজ্ঞানের গবেষকের কাছে আজ অনুদানদাতা সংস্থার একটিই প্রশ্ন— গবেষণালব্ধ ফলটি বাজারে বিক্রি হবে তো?
অথচ অনেক প্রযুক্তির উদ্ভাবন তো হচ্ছে বিজ্ঞানের কৌতূহল মেটাতে গিয়ে। সার্ন-এর গবেষণাগারে কণাপদার্থবিদ্যা চর্চার সময় বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন, কণায় কণায় ধাক্কা লেগে যে বিপুল সংখ্যায় ঘটনাপ্রবাহের (ইভেন্ট) সৃষ্টি হবে, তার থেকে উৎপন্ন রাশি রাশি সংখ্যার সংরক্ষণ ও ব্যাপক ব্যবহার কোনও টেবিল-কম্পিউটারের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার বিজ্ঞানকর্মীর কাছে সেই বিপুল আয়তনের ডেটার নাগাল পাওয়াও অসম্ভব হবে। তাই নতুন প্রযুক্তির প্রয়োজন। তারই ফল হিসেবে ইন্টারনেটের জন্ম। শুধুমাত্র ‘ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’ নয়, বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য ওই প্রযুক্তির দরকার ছিল।
২০১৭ সালে এক ইংরেজি পত্রিকা পাঁচ ভারতীয় বিজ্ঞানীর নাম প্রকাশ করেন, যাঁরা গড়পড়তা ভারতীয়দের আধুনিক জীবনযাপনে বিজ্ঞানের অবদান রেখেছেন— সি ভি রমন, হোমি জাহাঙ্গির ভাবা, জগদীশচন্দ্র বসু, বিক্রম সারাভাই এবং এ পি জে আব্দুল কালাম। এই তালিকা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। তবে লক্ষণীয়, এঁরা প্রত্যেকেই হাতেকলমে বিজ্ঞানের পরীক্ষা করেছেন, ‘এক্সপেরিমেন্টালিস্ট’।
বিজ্ঞানী কিন্তু মূলত স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। কখনও তাঁর সাক্ষাৎ যোগ থাকতে পারে বাস্তবের সঙ্গে, যেমন যখন তিনি কোনও প্রাণদায়ী ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য কাজ করেন। কিন্তু তাঁর মূল কাজ অনুসন্ধান। যিনি সারা জীবন ল্যাবরেটরিতে কাটিয়েছেন দিনে ষোলো কি আঠারো ঘণ্টা, দশ বছর আগেও লাইব্রেরিতে বসে চোখ রেখেছেন ধূলিধূসর বাঁধাই করা জার্নালের পাতায় (আজ হয়তো ডিজিটাল পত্রিকায়), যিনি কখনও বিক্রিবাটার সঙ্গে যুক্ত থাকেননি, তাঁর কাছে পেটেন্টযোগ্য পণ্য চাইলে, বা ওষুধের গুণযুক্ত নতুন অণুর সন্ধান চাইলে তিনি কোথায় যাবেন? নীতি আয়োগের কর্তারা এখন ‘বেসিক সায়েন্স’-এর সঙ্গে জুড়ছেন ‘সায়েন্স এডুকেশন’। গবেষণাকেন্দ্রগুলিতে অধ্যাপকদের বলা হচ্ছে, বেশি করে পড়ানো ও প্রচার প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে।
অযৌক্তিক নয়। বিজ্ঞানীরা ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর কাজটি উপেক্ষা করেছেন, যার ফল ভাল হয়নি। কিন্তু আক্ষেপ এই যে, পড়ানোর প্রয়োজনকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ‘বিনিয়োগের বিনিময়ে কী মিলল’ সেই উদ্বেগ। ছাত্রছাত্রীরাও বিজ্ঞান গবেষণাকে রোজগার ও বিনিয়োগের মতো করে দেখছেন। সারা বিশ্বেই বিজ্ঞানচর্চার আর্থিক অনুদান এক মস্ত প্রশ্ন। পরের প্রজন্মের জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় বা উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী কি অমনিই হবে?
সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজ়িক্সের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy