অঙ্কন: রৌদ্র মিত্র
জরাজীর্ণ শরীর। পাক ধরেছে চুলে। বয়সের ভারে ক্ষীণ হয়েছে দৃষ্টিশক্তি। তবুও এক দৃষ্টিতে গঙ্গাগর্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ফরাক্কা সেতুর দিকে চেয়ে রয়েছেন সত্তরোর্ধ্ব তোলা হালদার। সেতুর দিকে চেয়ে কী দেখছেন তিনি? তোলা হালদার বলছেন, ‘‘ফরাক্কা সেতু আমাদের কাছে আশীর্বাদ, না কি অভিশাপ? শেষ বয়সে এসেও সে অঙ্কের হিসেব মেলাতে পারলাম না! কারণ, সেতু তৈরি হওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে ভাঙন। আর ভাঙনের ফলে গ্রামের নামই হয়ে গিয়েছে ভাঙাটোলা। ভিটেমাটি হারিয়ে ছেলেমেয়ে নিয়ে নতুন করে ফের ঘর বেঁধেছি বহু বার। তবুও মনে হয়, এই ফরাক্কা সেতুই তো জুড়েছে রেল ও সড়ক পথে উত্তর ও দক্ষিণকে! সেতু হওয়ার পরেই তো জল বেড়ে আগের রূপ ফিরে পেয়েছে ভাগীরথীও!”
সালটা ১৯৬১। মালদহ ও মুর্শিদাবাদকে তখনও বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে গঙ্গা। নৌকায় গঙ্গা পেরিয়েই যোগাযোগ করতে হয় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের মানুষকে। ওই বছরই মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মধ্যবর্তী গঙ্গার উপর সেতু তৈরিতে উদ্যোগী হয় তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার। মালদহের বৈষ্ণবনগরের টাউনশিপ ও মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা এলাকায় শুরু হয় সেতু তৈরির কাজ। গঙ্গার উপর সেতু তৈরি করতে হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি সহযোগিতা নেয় তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার। দুই দেশ যৌথ ভাবে শুরু করে সেতু নির্মাণের কাজ। দীর্ঘ ২.৩০৪ কিলোমিটার লম্বা সেতু তৈরি করতে সময় লাগে প্রায় এক দশক। ১৯৭২ সালে শেষ হয় সেতু নির্মাণের কাজ। আর সেতুর উদ্বোধন করা হয় ওই বছরের ২১ এপ্রিল। সেতুটিতে ১০৯টি গেট রয়েছে। সেতু তৈরিতে সেই সময় খরচ হয়েছিল প্রায় ১৫৬ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা।
সেতুর এক পাশ দিয়ে গিয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। অন্য পাশে রয়েছে রেলপথ। সেতু তৈরির ফলে সড়কপথ ও রেলপথে জুড়ে যায় উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গ। শুধু উত্তরের সঙ্গে দক্ষিণই নয়, জুড়ে গিয়েছে ভারতের উত্তর-পূর্বও। ফরাক্কা সেতুর উপর চাপ কমাতে নতুন করে আরও একটি সেতু তৈরির কাজ শুরু করেছে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। যদিও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নবনির্মিত সেতুর একাংশ ভেঙে প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তাতে আহত হন বেশ কয়েকজন। নবনির্মিত সেতু তৈরিতে চিনা সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে কাজ করছিল ভারতীয় ঠিকাদার সংস্থা। দুর্ঘটনার পাশাপাশি চিনের সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হতেই কার্যত বিঁশ-বাও জলে চলে গিয়েছে গঙ্গার উপর ফরাক্কায় এই দ্বিতীয় সেতু নির্মাণের কাজ।
ফলে, ১৯৭২ সালের সেতুই এখনও ভরসা জোগাচ্ছে দুই বঙ্গের মানুষকে। ১৯৬২ সালে সেতুর পাশাপাশি দীর্ঘ একটি খালও খনন করা হয়েছিল। ভাগীরথী-হুগলি নদী পর্যন্ত প্রায় ৪০ কিলোমিটার খাল খনন করা হয়েছিল। সেই খালের ফলে ফুলে-ফেঁপে ওঠে ভাগীরথী। ফরাক্কায় গড়ে উঠেছে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রও। গঙ্গায় ফরাক্কা বাঁধ নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি কলকাতা বন্দরকে উদ্ধার করাও। ১৯৫০ ও ১৯৬০ সালের দিকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদী নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেই সময় দেখা যায়, নদীতে পলি জমে জমতে শুরু করেছে। যা চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল তৎকালীন প্রশাসনের কাছে। হুগলি নদীর পলি পরিষ্কার করার জন্য এই বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মালদহের নদীভাঙন বিশেষজ্ঞ মানব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পলি জমে নাব্যতা কমতে শুরু করেছিল কলকাতা বন্দরে। সেই সময় যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম ছিল নদীই। পলি জমে নদীর নাব্যতা কমে গেলে বন্দরে জাহাজ চলাচলে সমস্যা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা। তার জন্য ফরাক্কায় বাঁধ দিয়ে গঙ্গাকে আটকানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যার জন্য তৈরি করা হয়েছিল ফরাক্কা বাঁধ। কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বাড়ানো যেমন বাঁধের উদ্দেশ্য ছিল, তেমনই ভাগীরথী নদীতে জল বাড়ানোও ছিল ফরাক্কায় বাঁধ তৈরির অন্যতম লক্ষ্য।’’
কথায় আছে, নদী এক দিক ভাঙলে অন্য দিক গড়ে। ফরাক্কা বাঁধ হওয়ার ফলে যেমন যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, তেমনই নতুন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে মালদহ ও মুর্শিদাবাদের মানুষকে। তা হল গঙ্গাভাঙন। এই আতঙ্কেই দিন কাটাচ্ছেন গঙ্গাপাড়ের দুই জেলার মানুষ। বিহার, ঝাড়খণ্ড হয়ে মালদহের রতুয়া, মানিকচক, কালিয়াচক-২ ও বৈষ্ণবনগর ছুঁয়ে গঙ্গা মিশেছে বাংলাদেশের পদ্মার সঙ্গে। ঝাড়খণ্ড, বিহার ছুঁয়ে এলেও গঙ্গার বিধ্বংসী রূপ দেখেছে বাংলাই। নদী বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, মালদহের মাটিতে বালির পরিমাণ বেশি। যার ফলে গঙ্গাভাঙন দ্রুত হারে হয়েছে জেলায়। এখনও জেলায় অব্যাহত নদীর ভাঙন। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত জেলায় ব্যাপক হারে ভাঙন হয়েছে। এমনকি, মালদহের মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে কালিয়াচক-২ ব্লকের ঝাউবোনা গ্রাম পঞ্চায়েত। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, ভাঙনে ঘর ভেঙেছে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ, কয়েক হাজার হেক্টর জমি তলিয়ে গিয়েছে নদীতে। আমবাগানও তলিয়েছে বিঘার পর বিঘা। সাতটি প্রাথমিক এবং ১৪টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় তলিয়ে গিয়েছে নদীগর্ভে।
চলতি মরশুমেও গঙ্গাভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন বৈষ্ণবনগরের চিনাবাজার, দুর্গারামটোলা, সরকার টোলা, পারলালপুর, ফরাক্কার হুশেনপুর গ্রামের মানুষজন। ২০১৬ সালে ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছেন বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক স্বাধীন সরকার। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বন্ধুর বাড়িতেই ছিলেন। পরে ফের ঘর বেঁধেছেন গঙ্গাপাড়েই। তাঁর কথায়, ‘‘ফরাক্কা বাঁধের তলায় কংক্রিকেটর ঢালাই রয়েছে। গঙ্গার স্রোত বাধা পাওয়ার ফলে পলি জমছে নদীর বুকে। ফলে, নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। তাতেই ফি-বছর পাড় ভেঙে যাচ্ছে। ভাঙন রুখতে হলে প্রয়োজন নদীর নাব্যতা বাড়ানো। নদীর পলি তুলে ফেলা হলে ভাঙন অনেকটাই রোধ হবে।” চিনাবাজারের বাসিন্দা রবিউল শেখ বলেন, ‘‘এ কথা ঠিকই যে, ফরাক্কা বাঁধের ফলে আমরা দ্রুত দক্ষিণবঙ্গে পৌঁছতে পারছি। তবে, বাঁধ হওয়ার পর থেকে প্রতি বছর আমাদের সঙ্গী হয়ে উঠেছে নদীভাঙন। তাই ফরাক্কা বাঁধ দেখলেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে— এই বাঁধ আমাদের কাছে আশীর্বাদ, না কি অভিশাপ?’’বড় মাপের কাজের নানা কৌণিকতা থাকে। ফরাক্কা সেতুরও রয়েছে। মানুষের অনেক অভিজ্ঞতা, স্থানীয় বাসিন্দাদের নানা প্রতিবন্ধকতা জুড়ে রয়েছে এই সেতুর সঙ্গে। একই সঙ্গে এই সেতুর সঙ্গে বাঁধা পড়ে আছে ইতিহাসের বড় অধ্যায়ও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy