অর্থনীতির পণ্ডিতরা বলিতেছিলেন, এই বার বলিলেন পোপও। ক্যাথলিক বিশ্বের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের সাম্প্রতিক বাণীতে অভিবাসন, বর্ণবাদের পাশাপাশি উঠিয়া আসিয়াছে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আর্থিক অসাম্যের প্রসঙ্গ। পোপ মন্তব্য করিয়াছেন, অতিমারির ন্যায় সঙ্কটকালে বাজার অর্থনীতি অভ্রান্ত বিপত্তারণ না-ও হইতে পারে। এই সময় ব্যক্তিগত সম্পদের অধিকারও অবিসংবাদিত নহে। বরং কোন উপায়ে কিছু মানুষের কুক্ষিগত সম্পদকে সমষ্টির কল্যাণ ও সমাজের উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়, তাহাই বিচার্য বলিয়া মত দিয়াছেন পোপ ফ্রান্সিস। কথাটির মধ্যে কেহ সমাজতন্ত্রের সুর শুনিতে পারেন। কোভিডধ্বস্ত অর্থনীতি ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সামলাইতে নাভিশ্বাস উঠিয়া যাওয়া প্রথম বিশ্বের উন্নত দেশগুলিতে মাঝেমধ্যেই ‘প্যানডেমিক সোশ্যালিজ়ম’-এর কথা শোনা যাইতেছে। সেই আবহে পোপের উক্তিকে ‘ধর্মগুরুর ব্যক্তিগত মন্তব্য’ বলিয়া সরাইয়া রাখিবার জো নাই।
বহু দশক পরে সমাজতন্ত্র ফের ফ্যাশন হইয়াছে— বিশেষত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা অর্থনীতির বেগতিক বুঝিয়া ‘বিপ্লবী’ হইয়া উঠিয়াছেন— বামাচারীরা হয়তো আনন্দে দুই গাল ভাত বেশি খাইবেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ বলিয়াছেন, অতিমারি ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি ও উন্নয়নের মডেলের ভুলগুলি দেখাইয়া দিয়াছে। দেখাইয়া দিয়াছে, অতিমারির ন্যায় সঙ্কটকালে জীবিকা আয় ও সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনও বিলাসিতা নহে, জরুরি প্রয়োজনীয়তা। মাকরঁ বলিয়াছেন, কিছু পণ্য ও পরিষেবাকে বাজারের নিয়ম-নিগড়ের বাহিরেও ভাবা উচিত। অবশ্য, কার্ল মার্ক্স নহেন, এই পরিস্থিতিতে কার্যক্ষেত্রে ফের আরাধ্য হইয়াছেন জন মেনার্ড কেন্স। জার্মানি ৩৫৬ বিলিয়ন ইউরোর প্যাকেজ ঘোষণা করিয়াছে, তাহা দেশের জিডিপি-র ১০ শতাংশ। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়া দেশের সমস্ত সংস্থার শ্রমিক-কর্মচারীদের ৮০ শতাংশ অবধি মজুরি সরকার দিবে, ঘোষণা করিয়াছে ব্রিটেন। বার্ষিক ৭৫ হাজার ডলার অপেক্ষা কম উপার্জনকারী প্রত্যেককে ১২০০ ডলার করিয়া দিতেছে আমেরিকা। অর্থনীতিকে বাঁচাইতে ও জীবন-জীবিকার উদ্ধারে নাগরিকের হাতে অর্থ দান, ডুবন্ত বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সাহায্য, প্রয়োজনে আংশিক জাতীয়করণের নীতি— বাম ভাবাপন্নরা বলিবেন, এ সকলই উদারবাদী সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি।
উৎসাহের আতিশয্যে ধনতন্ত্রের শোক-সংবাদ পাঠ করিয়া ফেলিলে অবশ্য মুশকিল। সত্যই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হইলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বণ্টন করিবার মতো টাকা রাষ্ট্রের হাতে থাকিবে না— অর্থনৈতিক অকুশলতা সেই উদ্বৃত্তের সংস্থান করিতেই দিবে না। আসলে যে দাবিটি উঠিতেছে, তাহা বণ্টনের ন্যায্যতার দাবি। তাহার জন্য উৎপাদনের উপাদানের মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে সমর্পণ করিবার প্রয়োজন নাই। দরকার আসলে দায়িত্বশীল পুঁজিবাদের, যেখানে মুনাফার তুলনায় ক্ষুদ্রতর অংশ যাইবে পুঁজির মালিকের হাতে। ধনতন্ত্রকে দায়িত্বশীল করিয়া তুলিবার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রর হাতে উৎপাদনের অধিকার তুলিয়া দিয়া ব্যবস্থাটির কুশলতা নষ্ট করিবার মধ্যে নহে, বণ্টনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল করিবার মাধ্যমেই নিস্তার পাওয়া সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy