ব্যাপারটা যেন নিয়মের মতো হয়ে গিয়েছে। দীপাবলির রাতে মোমবাতির মায়াবী আলো আর আতসবাজির রোশনাই পেরিয়ে দিল্লির মানুষ জেগে উঠবেন ঝাপসা হয়ে থাকা দিনে, ভারী বাতাসে শ্বাস নিতে কষ্ট হবে। কয়েক দিন এমন চলবে, স্কুল ছুটি দিতে হবে, আর সেই সময় আমরা দিল্লি ও নানা জায়গার বায়ুদূষণ নিয়ে নানা রকম তথ্য দেওয়া-নেওয়া করব। তার পর এক দিন দিল্লির আকাশ নিয়ে ভাবনার নটেটি মুড়োবে, আমরাও ফিরে যাব নিজ নিকেতনে।
অবশ্য, নিকেতনটিও যে বাসযোগ্য থাকছে না সেটাও বহু দিন ধরেই জানানো হচ্ছে নানা রকম তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে। কিন্তু এ সব হিসেব আমাদের মন থেকে বায়বীয় পদার্থের মতোই নিমেষে উড়ে যায়; আমাদের চোখে-কানে ধরা না পড়লে কোনও বিপদকেই আমরা পাত্তা দিই না। তাই দূষণ বলতে আমরা প্রথমে বুঝি প্লাস্টিক (মানে ক্যারিব্যাগ), কারণ সেটা চোখে দেখা যায়, আর তার পরেই শব্দ। বাজির মরসুমে আমাদের মাথাব্যথা শব্দবাজি ও শব্দদূষণ নিয়ে— যেন আলোর বাজি থেকে দূষণ হয় না। তাই বায়ুদূষণের কারণ (ও ফলাফল) বিষয়ে পুরনো পড়া আবার ঝালিয়ে নেওয়া দরকার।
প্রথমত, নানা রকম গ্যাস, যেমন কার্বন, সালফার, নাইট্রোজেনের মনোক্সাইড ও ডাই-অক্সাইড, মিথেন, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ইত্যাদি। আমাদের নিঃশ্বাসের CO2 থেকে শুরু করে উনুন, শুকনো পাতা বা গাছের গোড়া পোড়ানো (CO), গাড়ি ও কলকারখানার ধোঁয়া, শীতাতপ যন্ত্রের নিঃসরণ এবং বাজি, সবাই দূষণকারী গ্যাসের উৎস।
দ্বিতীয়ত, পার্টিকুলেট ম্যাটার (পি-এম)— অর্থাৎ বাতাসে ভাসমান সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কঠিন ও তরল কণিকা। এদের ব্যাস ১০ মাইক্রোমিটার থেকে শুরু করে (PM10) আরও অনেক কম হতে পারে (PM2.5) (মানুষের চুলের ব্যাস ১০০ মাইক্রোমিটার)। ধুলোবালি, কার্বন কণিকা, সিমেন্ট, ছাই, ধাতু (সিসা) এই রকম অনেক কিছুই পিএম-এর উৎস হতে পারে; যত সূক্ষ্ম তত বেশি ক্ষতিকর। গাড়ি ও কারখানার কালো ধোঁয়ায় কার্বন-কণিকা বেশি থাকে, আগ্নেয়গিরির কাছাকাছি বাতাসে উড়ন্ত ছাই (ফ্লাই অ্যাশ) বেশি থাকে। এই সব ভাসমান কণিকা সমেত বাতাসকে বলা হয় বায়ুদ্রবণ (এরোসল)।
তৃতীয়ত, ভাসমান জৈব পদার্থকণিকা যার মধ্যে পরাগরেণু থেকে ভাইরাস, জীবাণু অনেক কিছুই পড়ে যায়। ভাসমান কণিকাগুলো শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে একেবারে সরাসরি শ্বাসনালী ও ফুসফুসে পৌঁছে গিয়ে নাক-গলা জ্বালা এবং কাশি থেকে ক্যানসার সব রকমই ঘটাতে পারে। দূষণকারী কিছু কিছু গ্যাস শ্বাসকষ্ট তো বাড়ায়ই আবার কম্বলের কাজও করে অর্থাৎ পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে প্রতিফলিত তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকেও রাখে, ফলে ভূপৃষ্ঠ ক্রমাগত উষ্ণ হয়ে ওঠে, যে ঘটনার নাম ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’ যা গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব-উষ্ণায়নের মূল কারণ। নাইট্রোজেন ও সালফারঘটিত কিছু গ্যাস আবার বাতাসের অক্সিজেন বা বৃষ্টির জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে আর একপ্রস্ত অক্সাইড, সালফেট ও নাইট্রেট জাতীয় অজৈব পদার্থের কণিকা, সালফিউরিক ও নাইট্রিক অ্যাসিড সৃষ্টি করে। এই দ্বিতীয় দফার কণিকাগুলো নিজেরা অনবরত নানা রকম ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায় আর পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলের ওজন অণুকেও ভাঙতে থাকে। এর ফলে অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে পড়ে, যা গাছপালা এবং মানুষের ত্বকের পক্ষে অতীব ক্ষতিকর।
বাজির কথা যখন উঠলই, দেখা যাক তার থেকে কী কী উপকারী পদার্থ বেরোয়! যত রকম গ্যাসের কথা ওপরে বলা হয়েছে বাজি পোড়ালে তার প্রায় সবগুলোই বাতাসে মেশে, সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রঙের আলোর জন্য দরকারি সিসা, পারদ, বেরিয়াম, স্ট্রনশিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি নানা রকম ধাতুর যৌগ, যা প্রচণ্ড তাপে ভেঙে সূক্ষ্ম ধাতবকণিকা তৈরি করতে পারে। থাকে পারক্লোরেট শ্রেণির রাসায়নিক যৌগ, যা জলের সঙ্গে মিশে সেখানেও দূষণ ঘটায়। সারা পৃথিবীর নানা জায়গার পরিসংখ্যান বলে বিভিন্ন উৎসবের ঋতুতে (বড়দিন, নববর্ষ, দেওয়ালি) এক একটা অঞ্চলের বাতাসে পিএম-এর মাত্রা ৫-১০ গুণ বেড়ে যায়। এই কণিকারা বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত থাকলে আলোকরশ্মির শোষণ ও বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে মাধ্যমের স্বচ্ছতা নষ্ট করে, যে কারণে দেওয়ালির পরের দিন চার পাশ ঝাপসা হয়ে থাকে, নজর চলে না। ২০১৭ সালে দিল্লিতে PM2.5 ও PM10-এর মাত্রা ১০০০ একক ছুঁয়েছিল যার নির্ধারিত মাত্রা ৬০ ও ১০০ একক। ব্যাপার দেখে মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবাল নিজেই দিল্লিকে গ্যাস-চেম্বার বলেছিলেন। অর্থাৎ যে বাজির রোশনাই দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবছেন আহা এ তো শব্দবাজি নয়, সেই বাজির চোখজুড়োনো আলো আর গাঢ় ধোঁয়া নিঃশব্দে কানফাটানো বাজির সমানই ক্ষতি করছে।
হ্যাঁ, সরাসরি ক্ষতির কথাটাই আমরা সবচেয়ে ভাল বুঝি, তাই এইবেলা জানিয়ে রাখি মাত্রাতিরিক্ত (অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজ়েশন বা ‘হু’-র নির্ধারিত মাত্রার অনেক ওপরে) বায়ুদূষণের কারণে ভারতে বছরে গড়ে ১২ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়। শুধু ২০১৭ সালেই ২ লক্ষ শিশু মারা গিয়েছে বায়ুদূষণজনিত রোগে, যার মধ্যে আছে অপরিণত অবস্থায় জন্ম, অপুষ্টি, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু রোগ শিশুটি ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই শরীরে বাসা বাঁধে গর্ভবতী মায়ের থেকে। তা ছাড়া ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার মতো পরিচিত রোগও (অর্থাৎ রোগের জীবাণুটি) যে আজকাল চরিত্র বদলে অদম্য হয়ে উঠছে, এর পিছনেও দূষণ ও জলবায়ু (ক্লাইমেট) পরিবর্তনের কারণ রয়েছে।
কথায় কথায় বায়ু থেকে জলবায়ুতে চলে এলাম। আসলে পরিবেশ ব্যাপারটাই এই রকম। বিষয়গুলো এমন পরস্পর-সম্পর্কিত যে অনেক সময়ই একটি বিশেষ ঘটনার প্রভাবে অন্য অনেক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক বিরাট পরিবর্তন ঘটাতে থাকে। যেমন গাছপালা কেটে, জীবাশ্ম-জ্বালানি (কয়লা, খনিজ তেল) এবং বাজি পুড়িয়ে বাতাসে CO2-র পরিমাণ বাড়ালাম, ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’-এর দরুন ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়ল, মেরু অঞ্চলের হিমবাহ গলে গিয়ে জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পেল, আবার বরফের খাঁচায় আটকে থাকা মিথেন হাইড্রেট ভেঙে মিথেন গ্যাসও বাতাসে মিশে ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’ বাড়াল। ফলত বিভিন্ন জায়গায় তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের চরিত্র মানে ঋতু-বৈচিত্র বদলাতে থাকল। অর্থাৎ এক অঞ্চলের জলবায়ু এবং তার ওপর নির্ভরশীল শস্যের উৎপাদন ও জীবক্রিয়া বদলাতে থাকল। এই গোটা ব্যাপারটা যেমন ১৫-২০ বছর ধরে আস্তে আস্তে ঘটে চলে, তেমনই সেই পরিবর্তনকে থামিয়ে আগের জায়গায় ফেরানোও সহজ কথা নয়।
এই সব কথাই আমাদের কমবেশি জানা কারণ ইস্কুল-কলেজে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে পরিবেশ বিজ্ঞান এখন সবাইকেই পড়তে হয়। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার মূল কথা হল সচেতনতা, তার উন্নতি কোথায়? ১৫৩টা দেশের এগারো হাজার বিজ্ঞানী একজোট হয়ে বিশ্বজোড়া জলবায়ু সম্পর্কিত এক ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করেছেন, যেখানে পরিষ্কার বলা আছে যে জলবায়ু বদলাচ্ছে— যা ভাবা গিয়েছিল তার চেয়ে অনেক দ্রুত এগিয়ে আসছে বিপদ! গত ৪০ বছর ধরে পরিবেশ বিষয়ক নানা রকম চুক্তি ও আলোচনা সত্ত্বেও জীবনযাত্রা এতটুকু বদলায়নি, সঙ্কটের গভীরতা মানুষ এতটুকুও বোঝেনি।
সুতরাং সবচেয়ে বড় অপরাধী হল CO2 যাকে ইচ্ছে করলে ধরা যায়। একটি মানুষের যাবতীয় কাজকর্ম থেকে যতটা CO2 (বা অন্যান্য গ্রিনহাউস গ্যাস) নিঃসরণ ঘটে, তার পরিমাপকে বলা হয় ‘কার্বন ফুটপ্রিন্ট’ (সিএফ)। সারা দিনে যা যা ব্যবহার করছেন, সে সবের উৎপাদনে যে CO2 নির্গত হয়, সব মিলেই এই হিসেব। স্বভাবতই এর প্রধান উৎস হল জীবাশ্ম জ্বালানি। তাই যে বস্তুর উৎপাদনে যত জ্বালানি খরচ হয় তার সিএফ তত বেশি; জ্বালানি-চালিত গাড়ি চড়লে সিএফ একলাফে উঠে যায়। পরিবেশ দূষণ কমাবার প্রথম পদক্ষেপই হল ব্যক্তিগত সিএফ কমানো। তার জন্য স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানটুকুই যথেষ্ট, যেমন ঘরের আলো-পাখা ‘অফ’ করা, লিফ্ট, এসি, হিটার ব্যবহার কমানো, গাড়ির বদলে হাঁটা বা সাইকেল চালানো; মানে নিজেরই তেল ও বিদ্যুৎ খরচ কমানো। তবে তার জন্য আগে দরকার, বিপদটাকে জানা ও তাকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব স্বীকার করা। কিন্তু যে পৃথিবীতে গ্রিনল্যান্ড কেনাবেচার কথা চলে, আমাজনের আগুনকে উপকারী ভাবা যায়, আর শ্বাসকষ্ট-চোখজ্বালাকে মেনে নিয়েও প্রতি বছর লোকে বাজির রোশনাইতে মুগ্ধ হয়ে ওঠে, সেখানে এ সব ধর্মের কাহিনিতে কান দেওয়ার মানুষ কোথায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy