ফুটিফাটা জমি। জলের অভাবে থমকে চাষ। নিজস্ব চিত্র
দেশজুড়ে জলসংকট। তার সঙ্গে আবহাওয়ার খেয়ালিপনা। উত্তরবঙ্গে ভারি বৃষ্টি তো দক্ষিণবঙ্গ, রাঢ়বঙ্গে বৃষ্টির জন্য হাহাকার।
পানীয় জলের সমস্যাও দেখা দিচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। বীরভূমের বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যেই নলকূপ থেকে জল উঠছে না। অনেকেই নিয়ম ভেঙে গভীর নলকূপও বসাচ্ছেন পানীয় জলের ঘাটতি মেটাতে। ভুগর্ভস্থ জল-লুঠ হচ্ছে বিভিন্ন পানীয় জলের কোম্পানি আর ঠান্ডা পানীয়, চিপস্-এর কোম্পানির দৌলতে। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা বলাই বাহুল্য। একই ভাবে জল পাচ্ছে না গাছের শিকড়ও। ধান থেকে আনাজ এমনকি বড় গাছের শিকড়ও মাটির তলার রসশূন্য হয়ে হাঁকপাঁক করছে।
এমনিতেই এবছর বর্ষা এসেছে দেরিতে। তার উপর খাতায় কলমে বর্ষা এলেও সেভাবে বৃষ্টির দেখা নেই। ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল রাজ্যবাসী। প্রভাব পড়েছে চাষবাসেও।
আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় কপালে ভাঁজ পড়েছে চাষিদের। বৃষ্টির অভাবে ক্ষতির মুখে চাষের কাজ। ভ্যাপসা গরমে মজুত আনাজ নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হতে থাকা ফসল বাজারেও দাম পাচ্ছে না।
মহম্মদবাজারের পেঁয়াজ চাষিরা প্রতি বছর এই সময় লাভের মুখ দেখেন। এবার উল্টো চিত্র। এবছর আবহাওয়া সহায় হয়নি। আর এই ভ্যাপসা গরমে পচে নষ্ট হচ্ছে পেঁয়াজ। একই ছবি মুরারই, লাভপুর, রামপুরহাট সংলগ্ন এলাকায়। একে বৃষ্টি নেই, তার উপরে কাঠফাটা গরম। ঢ্যাঁড়স, বেগুন, পেঁয়াজ বা পটল, কোনও আনাজেরই ফলন ভাল না। বাজারেও দাম পড়েছে।
সামান্য বৃষ্টিতেই অবশ্য জেলায় চাষের কাজ শুরু হয়েছে। অনেকেই সময় নষ্টের ভয়ে ধানের চারা লাগানোর প্রস্তুতি নিয়েছেন ক্ষতির আশঙ্কা নিয়েও। কয়েক জায়গায় শুরু হয়েছে বীজতলা তৈরির কাজ। কিছুদিন আগে বৃষ্টির হাজিরা দেখে চাষিরা বর্ষা আসছে ভেবে আমনের প্রস্তুতি শুরু করেন। কিন্তু মরীচিকার মতো বৃষ্টি ভ্যানিশ। অনাবৃষ্টির জেরে আমনের বীজতলা বাঁচাতে চাষিকে এখন একদিন অন্তর জল দিতে হচ্ছে। বীজতলার এলাকা ছোট হওয়ায় সেটা সম্ভব হলেও সেচ বাবদ চাষির উপরে বাড়তি খরচের বোঝা চাপছে। কিন্তু এসবের পরেও কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরকম গরম চলতে থাকলে আমন চাষ পিছনোর সম্ভাবনাও বাড়ছে। আমনের নির্ধারিত সময় সীমারেখা পিছোলে স্বাভাবিক ভাবেই পিছোবে বোরো চাষ। আলু, পেঁয়াজ বা অন্য আনাজ চাষও পিছিয়ে যাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শস্য পরিকল্পনা মার খাওয়ার সম্ভাবনাই প্রকট হচ্ছে।
বীরভূমের রুক্ষ মাটিতে তীব্র দাবদাহে শুকোচ্ছে ফুলের পরাগ রেণু। ফলে পরাগ মিলনে সমস্যার ফলে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে আনাজ চাষে। কিন্তু মাথায় রাখা দরকার এই সমস্যা শুধু এবারের নয়। এই সমস্যা সুদূরপ্রসারী। জেলার কৃষি আধিকারিকদের কথায়, আমন ধানের চাষ প্রধানত বৃষ্টি নির্ভর। তাই আমনের চাষিরা সাধারণত জল কেনার কথা ভেবে চাষ করেন না। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে বৃষ্টি সময়ের থেকে অনেক দেরিতে শুরু হলে ধান লাগাতেও দেরি হবে। ফলে চাষ পিছোবেই। বৃষ্টি না হলে বোরোর মতো সেচের জল দিয়ে চাষ করালে খরচ অনেকটাই বাড়বে। শুধু ধান নয়, সব চাষিরাই এই একই সমস্যার মুখোমুখি। আম চাষিরাও জানিয়েছেন, কলমের চারা তৈরি করে তাঁরা বসে আছেন। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে নষ্ট হচ্ছে সেই চারা। লক্ষ লক্ষ টাকার গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রবল ক্ষতির মুখে ‘অর্নামেন্টাল প্ল্যান্ট’-এর চারা তৈরি করার কারিগরেরাও। নার্সারিগুলির মালিকদের মাথায় হাত।
গরম, দাবদাহ, জলসংকট — এ যেন সাঁড়াশি আক্রমণ। কিন্তু এখন যে আমরা কপাল চাপড়াচ্ছি, মাথার চুল ছিঁড়ছি এ সবের মূলে তো আমরা নিজেরাই। দূষণকে প্রশ্রয় দিয়েছি। সস্তা এবং সহজলভ্য দূষণ ছড়ানোর হাতিয়ার প্লাস্টিককে আশ্রয় করেছি বছরের পর বছর। সামান্য গাছের চারার ক্ষেত্রেও যদি খেয়াল করা যায়, চটের মতো পরিবেশ বান্ধব বস্তুকে ছেড়ে লক্ষ – কোটি গাছের চারার মাটি শুদ্ধ শিকড় মোড়ানো হয়েছে প্লাস্টিকে। সেই প্লাস্টিক মাটিতে মেশে না। গাছের জন্য, ফসলের জন্য যত্রতত্র মাটি খুঁড়ে পাম্প বসানো হয়েছে। জলের স্তর ক্রমশ নেমেছে তবু পাইপের নীচে পাইপ জুড়েছি আমরাই। বৃষ্টির জল, ভূ-পৃষ্ঠের জলকে ধরে রাখার গল্পটা সোশ্যাল মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ রয়ে গিয়েছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে।
লেখক পরিবেশকর্মী ও গবেষক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy