কে জানে কী ভাবছেন কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা। ইতিমধ্যে রাজ্য বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক মশাই একাধিক বার বলেছেন যে, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি থেকেই নয়া নাগরিকত্ব আইন অনুযায়ী নাগরিকত্ব দেওয়া হবে বাংলাদেশ থেকে আসা ‘শরণার্থী’দের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বলেছেন, ‘শরণার্থী’রা নাগরিকত্ব পাবেনই। পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আসা বিরাট সংখ্যক নমশূদ্রকে লক্ষ করেই তাঁদের এই আশ্বাস বিতরণ। মুশকিলটা হল, এই আশ্বাস যে মোটেই পোক্ত নয়, তাঁরাও জানেন, ‘শরণার্থী’রাও। তাই জানতে ইচ্ছে করে কী ভাবছেন নেতারা। কোন হিসেব কষে মতুয়া পাড়ার সফর বাতিল করলেন অমিত শাহ।
গত কিছু দিন ধরে নাগরিকত্ব আইনের ঢালাও প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাংলার দলিতরা অনেক প্রশ্ন তুলেছেন। জরুরি প্রশ্ন। দলিত আদিবাসী মাইনরিটি আন্দোলন লিগ ইতিমধ্যে বিজেপির দিকে ছুড়ে দিয়েছে কঠিন জিজ্ঞাসা— নাগরিকত্ব পেতে হলে যা করতে হবে, সেটা তো সহজ নয়? সেটা করলে তাঁরা আরও বিপদে পড়বেন এমন আশঙ্কাও তো আছে? তবে কিসে ভোলাচ্ছেন নেতারা? কেন ভোলাচ্ছেন? ভোটের আশায় ভুয়ো প্রতিশ্রুতির ললিপপ?
প্রসঙ্গটা শুরু করতে হয় ‘শরণার্থী’ শব্দটা দিয়েই। কারা যে আজকের ভারতে শরণার্থী, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর শাসন শুরু হওয়ার পর থেকেই সেটা জলের মতো স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত হিন্দুরা, এবং (মুসলিম ছাড়া) অন্যান্য ধর্মপরিচয়-সম্বলিত মানুষরা ‘শরণার্থী’। বাকিরা (মুসলিমরা) ‘অনুপ্রবেশকারী’ (কিংবা ‘উইপোকা’)। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ কাগজে-কলমে বলেছে— প্রতিবেশী দেশ থেকে সংখ্যালঘু হিসেবে ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যাঁরা চলে এসেছেন তাঁরা সকলে ভারতে নাগরিকত্ব পাবেন।
এর মধ্যে অনুক্ত ও নিহিত দুটো শর্ত। এক, ধর্মীয় নির্যাতন যদি কোনও মুসলিমের উপর হয় (হয়তো তিনি পাকিস্তানের আহমদিয়া, কিংবা বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মুসলিম)— তিনি কিন্তু শরণার্থী আখ্যা পাবেন না, কেননা মুসলিমদের সেই আখ্যায় অধিকার নেই। দুই, অমুসলিম শরণার্থীদের অবশ্যই কিছু কাগজপত্র দেখাতে হবে যা প্রমাণ করবে, তিনি ২০১৫ সালের আগে ভারতে পা রেখেছেন, এবং ধর্মীয় নির্যাতনের কারণে এসেছেন।
কিন্তু কোথা থেকে আসবে এই কাগজপত্র? যাঁরা দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলেন, তাঁরা কি এই সব সঙ্গে এনেছিলেন? রাতের অন্ধকারে সীমানা পেরিয়ে আসেন যাঁরা, তাঁদের কাছে কি পাসপোর্ট কিংবা কোনও বৈধ নথিপত্র থাকে? কিংবা কবে এসেছেন, সেটা প্রমাণ করার মতো কোনও নথি থাকে কি— বাংলাদেশ বা ভারত, যে কোনও পক্ষের?
যাঁদের সে সব আছে, তাঁরা অনেকেই ইতিমধ্যে ভারতের পুরনো ‘ফরেনার্স অ্যাক্ট’ অনুযায়ী ভারতে থাকার আবেদন করেছেন। তাঁরা পাবেন সিএএ-র সুবিধে। কিন্তু যাঁরা নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও কোনও কারণে আবেদন করেননি, কোনও কারণে তাঁদের নতুন আবেদনটি গ্রাহ্য না হলে কিন্তু তাঁরা চিরতরে ‘আনরেজিস্টার্ড ফরেনার’ অর্থাৎ ‘অবৈধ বিদেশি’ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। আর, যাঁদের বৈধ নথিপত্র নেই— তেমন লোকই সংখ্যায় অনেক বেশি— তাঁদের কথা বলা বাহুল্য। তাঁরা আজ যদি আইনের স্ক্যানারে ধরা পড়েন, নাগরিকতার আশ্রয় তো তাঁরা পাবেনই না, ‘অবৈধ বিদেশি’ মার্কায় রাতারাতি পরিচিত হবেন। নিশ্চয়ই মনে আছে, সিএএ-র আগে আছে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি, এবং তার আগে আছে ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের পাশ করা নাগরিকত্ব আইন— যাতে বলা হয়েছিল একমাত্র ১৯৭১ সালের আগে ভারতে এলেই নাগরিকত্বের আবেদন করা সম্ভব! এ বারের আইনে সেই কাট-অফ বেড়ে ২০১৪-র ডিসেম্বর— তাই গত ছয় বছরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ‘ব্যবস্থা’র কথা কৈলাস বিজয়বর্গীয়রা মুখেও আনছেন না।
ফলে এ দেশ ও দেশ থেকে আগত অ-মুসলিমদের ‘ঢালাও নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়ার’ প্রতিশ্রুতিটি আসলে ভোটের আগে ‘চাকরির ফর্ম’ বিলি করার মতোই ব্যাপার আর কী। এমতাবস্থায়, যত দিন পর্যন্ত নথিপত্র দেখাতে হচ্ছে না, পশ্চিমবঙ্গের মানুষ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। তার পর নাগরিকত্ব ঘিরে যে নৈরাজ্য-কাণ্ড শুরু হবে, তার দাপটে ধর্মপরিচয় নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের বহু আজীবনের বাসিন্দাও সুস্থ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তাবোধ নিয়ে বাঁচতে পারবেন কি না, ঘোর সন্দেহ।
এ সব কোনও আকাশ থেকে আঁকশি দিয়ে পাড়া অনুমান নয়। অসমে ঠিক এটাই হয়েছে। এই কারণেই বিজেপির নতুন নাগরিকত্ব আইন নামক ছাঁকনিতে মুসলিম অনপ্রবেশকারী ধরা পড়বেন ভেবেও বাস্তবে ধরা পড়ে গিয়েছেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু! কেননা সেই হিন্দুদের অধিকাংশই ভারতে এসেছেন সব ছেড়ে, এমনকি নথিপত্রও ছেড়ে। আজ তাঁদের রাতারাতি কাগজ দর্শাতে বললে তার ফলটা কী হবে দেখাই যাচ্ছে— কাগজ খুঁজে না পাওয়া, নথিভুক্ত না হওয়া, এবং শেষ পর্যন্ত, ডিটেনশন ক্যাম্প।
এ রাজ্যের মতুয়া পক্ষ থেকে যে প্রশ্ন ও আপত্তি শোনা যাচ্ছে সিএএ-র বিরুদ্ধে, সেগুলি সাম্প্রতিক অসম-অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে তাই ভয়ানক গুরুতর। কেবল দলিত কেন, সমস্ত পশ্চিমবঙ্গবাসীরই উচিত গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা বিচার করা। প্রথমত, যে হেতু বাংলাদেশ থেকে আসা এই মানুষগুলিকে ঢালাও নাগরিকত্ব দেওয়ার বদলে একটা কাট-অফ তারিখ (৩১ ডিসেম্বর ২০১৪) দেওয়া হয়েছে এবং নথিপত্রের কথা বলা হয়েছে, তাতে মতুয়াদের ভয়ের অনেক কারণ। গত কয়েক বছর আসা মতুয়া ও অন্য নমশূদ্রদের কোনও সুরাহা হবে না এতে। বরং তাঁরা আরও ভাল করে ‘অবৈধ’ প্রমাণিত হবেন। সুতরাং অমিত শাহের ‘সকলে নাগরিকত্ব পাবেন’ বাক্যটি কেবল মুখের কথা নয়, রীতিমতো বিপথচালনাকারী কথা।
দ্বিতীয়ত, উৎস-দেশে ধর্মীয় নির্যাতনের প্রমাণ দেখানো কি সম্ভব? বাবা-মায়ের জন্ম সার্টিফিকেট? আঁধার রাতে সীমানা পেরোনো এই মানুষদের কাছে কী করে থাকবে এ-সব? বিরোধী পক্ষ থেকে যে প্রচার চলছে— নাগরিকত্ব আইন আসলে মতুয়াদের ফাঁদে ফেলার ছল— তাকে খুব ভুল বলা যায় কি?
তৃতীয়ত, একটা গভীরতর সংশয় আছে। বিজেপিরই শাসনে, বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে, পাশ হওয়া আগের আইনে ১৯৭১ সালের কাট-অফ তারিখটি ঘোষিত হওয়ার ফলে বহু নমশূদ্র মানুষ, যাঁরা তার পর পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, অনেক সময় দালাল-সূত্রে পারাপার করেছেন, কিংবা যাঁরা ভারতে বসবাসকারী নথিপত্রবিহীন বাবা-মায়ের সন্তান হিসেবে জন্মেছেন, তাঁরা রাতারাতি অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছেন। অথচ তখনও কিন্তু বিজেপির উদ্দেশ্য ছিল একই, হিন্দুতোষণের জন্য বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের দলে টানা। উদ্দেশ্য একই, তবু ফল হয়েছিল বিপরীত। এ বার ১৯৭১-এর বদলে কাট-অফ তারিখ ২০১৪, কিন্তু ফলাফল একই রকম হওয়ার আশঙ্কা কি উড়িয়ে দেওয়া যায়?
পশ্চিমবঙ্গবাসীর আরও একটা কথা ভাবার আছে। এত দিন ‘অনুপ্রবেশ সঙ্কট’ নিয়ে যে হইচই দেখা গিয়েছে এ রাজ্যে, শোনা গিয়েছে বাংলাদেশ থেকে ‘লোক ধরে এনে ভোটার বানানোর’ অভিযোগ, রাজ্যের সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যার মূলে নাকি এই বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত জনতার চাপই আসল দায়ী, সে কি কেবল মুসলিমদের জন্যই বরাদ্দ ছিল? না কি, অনুপ্রবেশ বিষয়টিকে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষেই একটা বড় সমস্যা ভাবছিলেন রাজ্যবাসী? যদি দ্বিতীয়টা ভেবে থাকেন, তা হলে হঠাৎ বিজেপির ‘ঢালাও’ নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতিতে এ রাজ্যের নাগরিকদের আত্যন্তিক প্রীত হওয়ার কি কোনও যুক্তি আছে? ইসলাম-ঘৃণায় ক্ষিপ্ত না হয়ে থাকলে বলতেই হবে, ‘রাজ্যের স্বার্থ’ নামক সমস্যাটার সমাধান কিন্তু এতে হচ্ছে না। জনসংখ্যা বেড়েই চলবে যদি সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্ব প্রদান শুরু হয়। রাজ্যের নয়, পুষ্ট হবে বিজেপির স্বার্থ।
বিজেপির স্বার্থসন্ধান আরও স্পষ্ট— যদি মনে রাখা যায় সম্প্রতি উন্নয়নশীল বাংলাদেশ ও পিছিয়ে-পড়া ভারতের তুলনামূলক পরিস্থিতি। বিএসএফ-এর একটা হিসেব বলছে, ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেআইনি পারাপার করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন যাঁরা, তাঁদের ৩১৭৩ জন বাংলাদেশে ফিরছিলেন, ১১১৫ জন ভারতে আসছিলেন। ২০১৯, ২০১৮, ২০১৭’তেও সংখ্যাগুলো এই রকমই। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতি বাড়ছে বলে তাঁদের আসাও দ্রুত কমছে। ফলে এই রাজ্যের স্বার্থ বিশেষ বিপন্ন, বিজেপি এমন বললেও, তথ্য তা বলছে না।
এ সবই স্বার্থের কথা। আদর্শের কথাও কিছু আছে, আজকের দিনে যতই তা বোকা-বোকা শোনাক। প্রতিবেশী দেশ থেকে যাঁরা আসেন, তাঁদের ‘উদ্বাস্তু’ বলার একটা চল ছিল বহু দিন। ক্ষেত্র বিচার করে তাঁদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনাও আছে। উদ্বাস্তুদের নিয়ে যা-ইচ্ছে-তাই করার নৈতিক অধিকার এ দেশের আছে কি? সিএএ-র মতো আইন, যা প্রকাশ্যে ‘উদ্বাস্তু’র কথা বলে, আর ভিতরে ‘মুসলিম-বিদ্বেষ’কে প্রায় জাতিবৈর-র স্তরে নিয়ে গিয়ে তাঁদের প্রাণে মারার ব্যবস্থা করে— এটাই কি তবে চাই এখন? এই পশ্চিমবঙ্গের আদর্শ?
তীব্র তীক্ষ্ণ মুসলিম-বিদ্বেষ কি তা হলে আর সব মূল্যবোধকে ভুলিয়ে দিতে প্রস্তুত?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy