সীতারাম ইয়েচুরি।
সীতারাম ইয়েচুরি আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পুণ্যভূমিতে বসিয়া তাঁহাদের দলের মরসুমি রেকর্ডখানি আরও এক বার বাজাইয়াছেন। রেকর্ডটি ফাটা। অতএব সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদক মহাশয়ের কথা একই জায়গায় আটকাইয়া গিয়াছে। রাজ্য কমিটির বৈঠকে তাঁহার পরিবেশিত কথামালার সারমর্ম: বিজেপিকে প্রধান শত্রু মনে করিলেও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী রাজনীতির স্বার্থে তৃণমূল কংগ্রেসকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়িয়া দেওয়া চলিবে না, তাঁহাদের পরাজিত করিয়াই বিজেপিকে হারাইতে হইবে। অর্থাৎ, তৃণমূল কংগ্রেস তাঁহাদের প্রথম ও প্রধান প্রতিপক্ষ। নির্বাচনে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ দুইটি দলকেই প্রধান প্রতিপক্ষ বলিবার অর্থ সোনার পাথরবাটির সন্ধান। সিপিআইএমের সাধারণ সম্পাদককে নির্বোধ মনে করিবার কোনও কারণ নাই, তিনি বিলক্ষণ জানেন সোনার পাথরবাটি হয় না। তথাপি তিনি এবং তাঁহার সহযোগীরা বাংলার হাটে সেই কল্পবস্তুটি চালাইতে বদ্ধপরিকর। কেন?
সহজ উত্তর: তাঁহারা চোখ হইতে ক্ষুদ্রস্বার্থের ঠুলি খুলিয়া ফেলিতে নারাজ, ফলে বৃহৎ স্বার্থের স্বরূপ দেখিতে ব্যর্থ। ক্ষুদ্রস্বার্থ তাঁহাদের ভুলিতে দেয় না যে, এক দশক আগে নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের নিকট পরাজিত হইয়া তাঁহাদের ক্ষমতার স্বর্গ হইতে বিদায় লইতে হইয়াছিল। সেই আহত অহঙ্কার তাঁহাদের চেতনাকে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে, দলনেতারা সেই আচ্ছাদন সরাইয়া রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থ কিছুতেই দেখিবেন না। এই না-দেখিবার সিদ্ধান্তে যে এক প্রকাণ্ড প্রবঞ্চনা আছে, সেই সত্যও তাঁহাদের কথায় বারংবার ফুটিয়া উঠে। নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে ভাবে আধিপত্য বিস্তার করিতে তৎপর, অমিত শাহের সেনাপতিত্বে এই দলের নির্বাচনী অভিযান যে রূপ ধারণ করিয়াছে, তাহার তাৎপর্য সিপিআইএম নেতারা বিলক্ষণ জানেন। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিতে এই দলটির আধিপত্য কতখানি ক্ষতিকর হইয়া উঠিতে পারে, সে কথা তাঁহারা অস্বীকার করেন না, ইয়েচুরি তাঁহার রাজ্য কমিটির ভাষণেও সেই বিপদের কথা বলিয়াছেন। কিন্তু এই সমস্ত স্বীকৃতির পরে তিনি যথারীতি গরুর রচনায় ফিরিয়া আসিয়াছেন। বুঝিয়াও না বুঝিবার এই দুর্বুদ্ধি এ দেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম যৌবনেই তাহার সর্বজ্ঞ নেতাদের আচরণে প্রকট হইয়াছিল, সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।
নেতৃত্বের এই অনমনীয় অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় নির্ভেজাল সুযোগসন্ধানীদের প্রশ্রয় এবং উৎসাহ দিতে পারে, সাধারণ সম্পাদক ইত্যাদি নেতাদের ‘উহারাও প্রধান শত্রু ইহারাও প্রধান শত্রু’ নীতিকে কাজে লাগাইয়া ওই সন্ধানীরা ‘আগে ইহাদের তাড়াও পরে উহাদের তাড়াইব’ বলিয়া প্রচারে নামিতে পারেন। জনশ্রুতি— তেমন প্রচার অনেক দিন ধরিয়াই চলিতেছে, ভোটের হাওয়া যত বাড়িবে সেই প্রচারও তত বাড়িবে। অনুমান, ইয়েচুরি ও তাঁহার বঙ্গীয় সহচররা থাকিয়া থাকিয়া তাহাতে ইন্ধন দিবেন। তাঁহারা আত্মপক্ষ সমর্থনে বলিতেই পারেন যে, নীতি-ভিত্তিক লড়াই, জনসাধারণের সমস্যা সমাধানের দাবিকে কেন্দ্র করিয়া গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, ইত্যাকার নানা লক্ষ্যের কথা তো তাঁহারা বলিতেছেন, ইয়েচুরির ভাষণেও সেই সকল সদুক্তি শোনা গিয়াছে। সাধু। শাসকের অক্ষমতা, অন্যায় এবং অনাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা অবশ্যই বিরোধীদের দায়িত্ব। সিপিআইএম ও তাহার সহযোগী বামপন্থীরা গত দশ বছরে সেই দায়িত্বের কত শতাংশ পালন করিয়াছেন, সেই প্রশ্ন তুলিয়া তাঁহাদের বিব্রত করিবার প্রয়োজন নাই। দেরিতে জাগিলেও যদি জাগিয়া থাকেন, ভাল। তবে কিনা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করিবার জন্য পায়ের নীচে জমিটি ধরিয়া রাখা দরকার। বৃহৎ স্বার্থ বিসর্জন দিলে অনেক সময়েই ক্ষুদ্র স্বার্থও হারাইতে হয়। এই প্রাথমিক সত্যটি প্রাজ্ঞ বামপন্থীরা আর কবে শিখিবেন? সব শেষ হইবার পরে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy