Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Narendra Modi

আকাশ থেকে জমির সমাধান?

ভারতে জমির মালিকানার গল্পটি জটিল। কেনা-বেচার পর রেজিস্ট্রি ও মিউটেশনের দ্বারা মালিকানা নির্ধারিত হয় ৫-৬ শতাংশ জমির, বাকি জমি হাত বদলায় শুধু উত্তরাধিকারে।

নরেন্দ্র মোদী। ছবি: সংগৃহীত

নরেন্দ্র মোদী। ছবি: সংগৃহীত

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১০ নভেম্বর ২০২০ ০১:৩৬
Share: Save:

ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ডের পর এ বার সম্পত্তি কার্ড। অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সূচনা করেছেন সম্পত্তি কার্ডের। প্রথম দফায় এক লক্ষ গ্রামীণ নাগরিককে এই কার্ড দেওয়ার কথা। এ হল গ্রামাঞ্চলে বসতজমি ও বাড়ির কার্ড। মহারাষ্ট্রের পুণে জেলায় সোনারি গ্রামে এর পাইলট প্রকল্প হয়েছিল। পঞ্চায়েত দফতর আর সার্ভে অব ইন্ডিয়ার যৌথ উদ্যোগে জিপিএস লাগানো ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে বসতজমির ছবি তোলা হয়। তা থেকে জমি ও বাড়ির এলাকা নির্ধারিত করে, নম্বর বসিয়ে, বর্তমান মালিকানার তথ্য তহসিলদার অফিস থেকে নিয়ে একটি কার্ড তৈরি হয়। শুধু গ্রামে নয়, মুম্বই, পুণেতেও এই প্রকল্প হয়েছে। সোনারি গ্রামের সাফল্য দেখে সারা মহারাষ্ট্র জুড়ে সব গাওথান-এ (গ্রামাঞ্চলে বসতজমি) এই কাজ শুরু হয়েছে। দেখাদেখি হরিয়ানা, কর্নাটকেও পাইলট চলছে।

সেই ধারাতেই এ বার সারা দেশে ‘সম্পত্তি কার্ড’ আসছে। সরকারের দাবি, এর ফলে বসতসম্পত্তি বাঁধা রেখে ঋণ নেওয়া, বা সম্পত্তি বিক্রি করায় সুবিধে হবে গ্রামীণ পরিবারগুলির। গ্রামের বসতজমি-বাড়ির যথাযথ রেজিস্টার তৈরির ফলে পঞ্চায়েতেরও কর আদায়ে সুবিধা হবে।

তা হলে এত দিন কি গ্রামের জমির মানচিত্র ছিল না? ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশরা সারা দেশ জুড়ে জমি জরিপ করেছিল। সেই থেকে প্রতিটি গ্রামের মানচিত্র, জমির মালিকানার নথিপত্র তহসিলদার অফিসে রাখা থাকে। সরকারি হিসেবে ১ কোটি ১৩ লক্ষ মানচিত্র, আর ২৪ কোটি ৪৮ লক্ষ জমি-রেকর্ড আছে। তার প্রায় সবই চাষের জমির, কারণ তারই খাজনা নিত জমিদার ও ইংরেজরা। বসত এলাকার খাজনা ছিল না বলে জরিপ, মানচিত্র হত না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, অধিকাংশ রাজ্যে আজও অবস্থা প্রায় একই রয়ে গিয়েছে।

এখন বসতজমির ‘ম্যাপ’ হবে কী করে? সরকার জানিয়েছে, ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা হবে, সেই ছবিকে মাটির বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে চুন দিয়ে সীমানা টানা হবে। তার পরে জমির রেকর্ডের সঙ্গে মেলাতে হবে। গ্রামের লোক, গ্রাম পঞ্চায়তের ও পাটোয়ারির (এ রাজ্যে রেভিনিউ ইনস্পেক্টর) সাক্ষ্য নিয়ে মালিকানা ঠিক হবে। দরকারে জমির রেকর্ড পাল্টাতে হবে, বাড়ির মাপ-ধরন-বাসিন্দাদের নাম বসাতে হবে। তা দিয়ে তৈরি হবে সম্পত্তি কার্ড।

খটকা অনেক। প্রথমত, জমির জরিপ ও মালিকানা নির্ণয় রাজ্য সরকারের এক্তিয়ারে, কেন্দ্রের নয়। কেন্দ্র এই প্রকল্প রূপায়ণে টাকা দেবে ৭০ ভাগ, রাজ্যকে দিতে হবে ৩০ ভাগ। তার মানে রাজ্য উৎসাহিত না হলে হবে না। পঞ্চায়েত ও গ্রামের মানুষের পূর্ণ সহযোগিতা ছাড়াও হবে না।

দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে জমি-বাড়ির মালিকানা অনেকের। পৈতৃক জমিতে, বাবা-মায়ের অনুপস্থিতিতে একাধিক ভাই আর অবিবাহিত বোন একসঙ্গে থাকেন। কার নামে কার্ড হবে? এক জমিতে দুই ভাই আলাদা বাড়ি করে থাকার উদাহরণও কম নয়। সেখানে জমি ভাগ কী করে হবে? হয়তো সেই জমিতেই একটা ছোট গম পেষাই কল বা সাইকেল সারাইয়ের দোকান চলে। দোকানের মালিক মেজো ভাই, জমির মালিক পরিবার, তখন? বসত এলাকাতেই একটা বাঁশবন বা পুকুর থাকলে তার মালিকানা কার? বিয়ের পরে যে মেয়েটি অন্যত্র চলে গিয়েছে, তারও তো পৈতৃক জমিতে অধিকার আছে। জমি মেপে বসতবাড়ির মালিক ঠিক করতে গেলে মেয়েরা বঞ্চিত হবে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ভারতে জমির মালিকানার গল্পটি জটিল। কেনা-বেচার পর রেজিস্ট্রি ও মিউটেশনের দ্বারা মালিকানা নির্ধারিত হয় ৫-৬ শতাংশ জমির, বাকি জমি হাত বদলায় শুধু উত্তরাধিকারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জমির নথিতে নাম বদল হয় না। বসতবাড়ির বাড়তি সমস্যা হল, ভারতে প্রায় অর্ধেক পরিবার যৌথ। সাধারণত হিন্দু সমাজে শুধুমাত্র পুত্রসন্তানদের জমি-বাড়ি পাওয়ার রীতি; সমাজের ফরমান সেই অনুযায়ী হবে। আইনের ফরমান তার সঙ্গে পেরে উঠবে না।

এ সব সমস্যা অজানা নয়। তা হলে ড্রোন দিয়ে মালিকানা নির্ধারণের চেষ্টা কেন? আসলে প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, তত মানুষের ধারণা হচ্ছে যে, তা দিয়েই সমাজের প্রায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেনটারো টয়োমার বিখ্যাত বই দ্য গিক হিয়ার্সি-র কথা মনে পড়ে। তিনি ভারতে মাইক্রোসফট-এর শীর্ষকর্তা ছিলেন পাঁচ বছর— তাঁর স্বপ্ন ছিল প্রযুক্তি দিয়ে ভারতের স্কুল শিক্ষার সব সমস্যা সমাধান করবেন। জমিতে কাজ করে বুঝতে পারেন, আসলে প্রযুক্তি চলতি সামাজিক-প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়াগুলিকেই জোরদার করে। সেই প্রক্রিয়া যদি ভাল হয় তা হলে ভালটাই বাড়বে, খারাপ হলে খারাপটাই বাড়বে। স্কুলশিক্ষার দুরবস্থার কারণ প্রযুক্তির অভাব নয়।

জমির মালিকানা ও নথিপত্রের দুরবস্থার কারণও ড্রোন ক্যামেরার বা প্লাস্টিক কার্ডের অভাব নয়। যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বাস্তবিক মানুষের সক্ষমতা বাড়াতে পারে, তার অভ্যাস করছে কে?

আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Property Card SVAMITVA scheme BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy