Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

রহিয়া ও সহিয়া

এই প্রসঙ্গে একটি গভীরতর প্রশ্ন উঠিয়া আসে। তাহা দ্রুততার প্রশ্ন, তাড়াহুড়ার প্রশ্ন। সব কাজ সব সময় তড়িৎগতিতে করিয়া ফেলিতে হইবে কেন?

শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:০১
Share: Save:

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় একটি অভিনব সিদ্ধান্ত লইয়াছে। তাহারা গণিত এবং কম্পিউটার সায়েন্স পরীক্ষায় নির্ধারিত সময় পনেরো মিনিট বাড়াইয়া দিয়াছে। আগে পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ সময় ছিল নব্বই মিনিট, এখন তাহা করা হইয়াছে একশো পাঁচ মিনিট। এবং দেখা যাইতেছে, ইহাতে ছাত্রছাত্রীদের ফল ভাল হইয়াছে। তাহা নিতান্ত স্বাভাবিক। পাশাপাশি, ছাত্রদের তুলনায় ছাত্রীদের ফলে বেশি উন্নতি হইয়াছে। অর্থাৎ, দ্রুত ভাবিতে ও লিখিতে ছেলেরা অধিক পারঙ্গম। পরীক্ষার জন্য বেশি সময় বরাদ্দ করিয়া অক্সফোর্ড ছেলেদের এই বাড়তি দক্ষতা কিছু পরিমাণে কাড়িয়া লইয়াছে। ফলে তর্ক উঠিয়াছে, মেয়েদের বাড়তি সুযোগ দেওয়া হইবে কেন? প্রশ্নটি অবান্তর নহে। তবে মেয়েদের বিরুদ্ধে দীর্ঘলালিত বৈষম্যের প্রতিষেধক হিসাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে— রাজনীতি হইতে পেশা, পড়াশোনা হইতে ভোটাধিকার, এমনকী ইউরোপের নানা দেশে কর্পোরেট সংস্থার বোর্ড-সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও মেয়েদের জন্য কার্যত আসন সংরক্ষিত থাকিতেছে। দীর্ঘ বঞ্চনার ফলে মেয়েদের বিরুদ্ধে পাল্লা ঝুঁকিয়া আছে বলিয়াই তাহাদের বাড়তি সুবিধা দিয়া ভারসাম্য আনিবার চেষ্টা। এই ভারসাম্যের কথা মনে রাখিয়াই অক্সফোর্ডের সিদ্ধান্ত।

কিন্তু এই সিদ্ধান্তের পক্ষে বৃহত্তর যুক্তিও আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকদের মতে, অঙ্ক পরীক্ষায় মেধার বিচার করা হয়, ইহা ‘সময়ের পরীক্ষা’ নহে। অর্থাৎ, কে কত তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান করিতে পারিল, তাহা প্রধান বিচার্য নহে। কথাটি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে সময়ের হেরফের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে ততটা নহেও। যিনি প্লেন চালাইবেন বা যুদ্ধ করিবেন বা কম্পিউটার প্রযুক্তি কাজে লাগাইয়া নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কাজ তুলিবেন, তাঁহার পক্ষে ন্যানোসেকেন্ডের গুরুত্বও অনেক। কিন্তু যিনি গবেষণা করিবেন বা শিক্ষকতা, তিনি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়া দৌড়াইবেন কেন? তিনি ভাবনাচিন্তার জন্য কিছুটা বেশি সময় দিলে, ক্ষতি কী?

এই প্রসঙ্গে একটি গভীরতর প্রশ্ন উঠিয়া আসে। তাহা দ্রুততার প্রশ্ন, তাড়াহুড়ার প্রশ্ন। সব কাজ সব সময় তড়িৎগতিতে করিয়া ফেলিতে হইবে কেন? অবশ্য দুনিয়ার দিনযাপন যে দ্রুতি-সর্বস্ব প্রযুক্তির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছে, তাহাতে এই দ্রুততার ভজনাই হয়তো স্বাভাবিক ঠেকে। কিন্তু গভীর চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে এই দ্রুততাই বিপদ ডাকিয়া আনিতেছে। যে কোনও বিষয় স্থিরভাবে চিন্তা না করিয়াই সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবার তাড়া মানুষকে এক অদ্ভুত অগভীর জীবনের দিকে ঠেলিয়া দিতেছে। সার্বিক মননে এই সময়ের চাপ ব্যাপক প্রভাব ফেলিতেছে। অনেক সমস্যার বিভিন্ন দিক ও মাত্রা থাকে, তাহার সমাধান খুঁজিতে চাহিলে গভীর বিবেচনার প্রয়োজন হয়। বিবেচনা শান্ত এবং স্থির চিন্তার সময় চাহে। ‘র‌্যাপিড ফায়ার’ পদ্ধতিতে প্রকৃত বিচার-বিশ্লেষণ সম্ভব নহে। চিন্তার জগৎটি উত্তরোত্তর একটি র‌্যাপিড-ফায়ার জগতে পরিণত হইতেছে। তাহার পরিণামে মানুষ সমস্ত প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দাবি করিতেছে এবং ভুল উত্তর পাইয়া নিজেদের প্রতারণা করিতেছে। ‘মেয়েদের বেশি সুবিধা’ করিয়া দিয়া যদি এই দ্রুতির বিড়ম্বনা হইতে নিজেদের মুক্ত করা যায়, তবে মানবজাতির মঙ্গল। কেবল মেয়েদের নয়, ছেলেদেরও।

অন্য বিষয়গুলি:

Oxford University Examination Time analysis
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE