Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪

বিজ্ঞাপনেই কি সব কাজ হবে

কন্যাসন্তান যে বোঝা, দেশের মহিলাপুরুষ অনুপাতই বলে দেয়। এক হাজার পুরুষ প্রতি মহিলার সংখ্যা ৯৪৩ (২০১১ জনগণনা)। অন্য দিকে, ন্যূনতম বিয়ের বয়স নিয়ে রাষ্ট্রের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশে অপ্রাপ্তবয়সি বিবাহিত ছেলেমেয়ের সংখ্যা এক কোটি একুশ লক্ষ।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

পিয়ালী পাল
শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০১৯ ০০:১৯
Share: Save:

মাধ্যমিক পাশ করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার আগেই শুরু হয় তার বিয়ের প্রস্তুতি। বিউটি সরকারের পরিবার সচ্ছলতায় মোড়া। তবু বাড়ির ‘বড় মেয়েকে পার করতে পারলে পরের কন্যাদের জন্য আরও সুবিধা হবে’। অতএব, নিত্য অশান্তির মধ্য দিয়ে পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাহায্যে কোনও রকমে বিয়ে আটকানো গেলেও নিয়মিত স্কুলে আসা অনিশ্চিত। এ দিকে পড়াশোনা করে দিদিমণি হওয়ার স্বপ্ন তার চোখে; কল্পনা, কন্যাশ্রীর টাকায় কলেজে পড়বে।

কন্যাসন্তান যে বোঝা, দেশের মহিলা পুরুষ অনুপাতই বলে দেয়। এক হাজার পুরুষ প্রতি মহিলার সংখ্যা ৯৪৩ (২০১১ জনগণনা)। অন্য দিকে, ন্যূনতম বিয়ের বয়স নিয়ে রাষ্ট্রের আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশে অপ্রাপ্তবয়সি বিবাহিত ছেলেমেয়ের সংখ্যা এক কোটি একুশ লক্ষ।

বাংলায় মোট বিবাহিত মহিলার মধ্যে ৪০ শতাংশেরই বিয়ে হয় ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে। মুর্শিদাবাদ, নদিয়া এবং পূর্ব মেদিনীপুর সবার উপরে। প্রায় ৪ লক্ষের বেশি কন্যাকে প্রাথমিক স্কুলে পাঠানোর বদলে বসানো হয় বিয়ের পিঁড়িতে। উচ্চপ্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই (১০-১৩ বছর) বিয়ে হয়ে যায় বাল্যবিবাহিতাদের ১০ শতাংশের।

দারিদ্র, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষার অভাব, লিঙ্গবৈষম্য, সামাজিক নিরাপত্তা প্রভৃতি মেয়েদের বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ বলা হয়। সমাজে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এই সব বৈশিষ্ট্য প্রকট বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু ‘ধরে নেওয়া’ আর বাস্তবের বিস্তর ফারাক। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে কন্যা বাল্যবিবাহ সবচেয়ে কম আদিবাসীদের মধ্যে (৩৬%), যাঁরা আর্থ-সামাজিক ভাবে সবচেয়ে বঞ্চিত ও পশ্চাৎপদ। আবার দলিতদের মধ্যে এই সংখ্যাটা (৪৬%) বেশি হলেও ভৌগোলিক প্রভেদ বিরাট। সমস্ত জেলাতে এই বাল্যবিবাহের হার সমান নয়। কোচবিহার, বাঁকুড়া ও বীরভূমে দলিতদের মধ্যে এটা বেশি দেখা যায়। দলিত ও আদিবাসী ছাড়া অন্য গোষ্ঠীদের কী অবস্থা? ২০১১-র জনগণনায় সমাজের এগিয়ে-থাকা অংশের মধ্যে মেয়েদের বাল্যবিবাহের ঘটনা স্পষ্ট। মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সর্বাগ্রে। অথচ সামাজিক পরিকাঠামোর দিক দিয়ে দুই জেলার মধ্যে বিস্তর ফারাক। শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব মেদিনীপুরের সাক্ষরতার হার ৮৭ শতাংশ। মুর্শিদাবাদে মাত্র ৬৭। অতএব সাক্ষরতা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কেবল এর জোরেই বাল্যবিবাহের ‘রোগ’ প্রতিরোধ করা সহজ নয়।

আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারগুলোতে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা গরিব পরিবারের তুলনায় কম। কিন্তু সেই ‘কম’ সংখ্যাটি দশ শতাংশ হলে দুশ্চিন্তার কারণ যথেষ্ট। দলিত, আদিবাসী ও মুসলমানদের মধ্যে যে হেতু বিত্তবান সামান্যই, ধরে নেওয়া যায় এরা আসছে হিন্দু উচ্চ বা মধ্যবর্ণ থেকে। নদিয়ায় আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবার থেকে অর্ধেকের কাছাকাছি মেয়ের বিয়ে ১৮-র নীচে হয়।

সম্প্রতি নদিয়ায় করা সমীক্ষায় দেখছি, প্রজননক্ষম ১৬৬ জন মায়ের মধ্যে ৫১ জনের বিয়ের সময় বয়স ১৮-র কম। প্রতি চার জনের এক জন হিন্দু উচ্চবর্ণ, বিত্তবান, ‘শিক্ষিত’ পরিবারের। দলিতদের মধ্যে শিক্ষার হার তুলনায় ভাল, তাঁদের মধ্যেও একই প্রবণতা। মুসলমানরাও ব্যতিক্রম নন। আর্থিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে দেখছি পারিবারিক বার্ষিক গড় আয় বাহাত্তর হাজারের মতো। ১৮-র নীচে বিয়ে হওয়া অর্ধেকেরও বেশি মা এমন পরিবারের, যার বার্ষিক আয়ের সমান বা বেশি। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান রেবতীর বিয়ে হয় অপ্রাপ্তবয়সে। স্বামী জানান বিয়ের সময় মেয়েটির বয়স কম হলেও পাত্রী ‘হাতছাড়া’ করতে পরিবার রাজি হয়নি। তাই, ‘আর্থিক অসঙ্গতি’ বাল্যবিবাহের অন্যতম কারণ, এমনও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না।

মেয়েদের বাল্যবিবাহের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কম বয়সে বিয়ে হওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি গর্ভধারণ অধিকাংশ সময়ে মা এবং শিশুকে বিপন্ন করে। শিশুমৃত্যু বা প্রসূতিমৃত্যু গ্রামীণ জেলাগুলিতে খুবই সাধারণ ব্যাপার। মুর্শিদাবাদে অন্য একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে ১৮-র নীচে বিয়ে হওয়া মেয়েদের একটা বড় অংশের পরিণতি ‘প্রসূতিমৃত্যু’।

২০১৬ সালে এক জেলাস্তরীয় সভায় মেয়েদের বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি নিয়ে গবেষকরা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলে সরকারি আধিকারিকরা তা খারিজ করে দেন। ২০২১ সালের জনগণনায় অনুপাতটা হয়তো কিছু কম হবে। কিন্তু, সংখ্যাই তো সব নয়। সমস্যাকে সংখ্যানির্ভর হিসেবে না দেখে বাস্তব দিকগুলোও বোঝা দরকার। কেন সচ্ছল পরিবারে কম বয়সে বিয়ে হচ্ছে, কেন শিক্ষার সুযোগ পাওয়া বাড়িগুলো কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারছে না, এ-বিষয়ে আলোচনা নেই। পশ্চাদ্‌গামিতার সংস্কৃতি একক, বিচ্ছিন্ন হতে পারে না। সমাজের সর্বক্ষেত্রে তার অধিষ্ঠান, সর্বত্র ছড়ানো তার শিকড়। কেবল বাল্যবিবাহ বন্ধের বিজ্ঞাপন নয়। মেয়েরা পূর্ণ মানুষের সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে যাতে, সেই জন্যও এই শিকড় ওপড়ানো জরুরি।

ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ, কল্যাণী

অন্য বিষয়গুলি:

Girl Child Kanyashree Prakalpa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy