ছবি: সংগৃহীত
দায়িত্বের গভীরে নিহিত রহিয়াছে দায়। কেবল শব্দে নহে, ধারণাতেও। দায়বোধ জোরদার হইলে তবেই দায়িত্বজ্ঞান পাকাপোক্ত হইতে পারে। জনজীবনে সমস্যা দেখা দিলে সমাজকে দায়িত্ববোধের পরীক্ষা দিতে হয়। সঙ্কট যত কঠিন, পরীক্ষা তথা এব চ। কোভিড-১৯ দুনিয়া জুড়িয়াই মানবসমাজকে অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়াছে। কলিকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গও, অনিবার্য ভাবেই, পরীক্ষার্থীর আসনে। এই সংক্রমণ ও তাহার মোকাবিলার কাহিনিতে উত্তরোত্তর একটি কথা স্পষ্ট হইতে স্পষ্টতর: রাষ্ট্র, শিল্পবাণিজ্য সংস্থা, বেসরকারি বা অসরকারি সংগঠন, নাগরিক সমাজ, পরিবার— কোনও প্রতিষ্ঠানই দায়িত্ব অস্বীকার করিতে পারে না। এই সত্যও মনে রাখা দরকার যে, সমস্ত স্তরের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ববোধের প্রথম শর্ত ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ। কিন্তু, সমস্ত স্তরেই, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আপন দায় মানিলে তবেই দায়িত্ব পালনের যথেষ্ট তাগিদ তৈয়ারি হইতে পারে। অথচ, দুঃখের কথা— এবং দুশ্চিন্তার কথা— সেই দায় এড়াইবার প্রবণতাই এ দেশে নানা ভাবে প্রকট। রাষ্ট্রের দায় এড়াইবার অগণন কথা ও কাহিনি প্রতিনিয়ত প্রচারিত হইতেছে। তাহা অত্যন্ত জরুরি। রাষ্ট্র আপন দায় স্বীকার না করিলে গণতন্ত্র ব্যর্থ। রাষ্ট্রকে তাহার দায় স্বীকারে বাধ্য না করিতে পারিলে গণতন্ত্রের অক্ষমতাই প্রমাণিত হয়।
কিন্তু অতিমারির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াইয়ে ব্যক্তি তথা জনসমাজের দায়বোধ এবং দায়িত্বজ্ঞানের মূল্যও অপরিসীম। সেই দায়দায়িত্বের দুইটি মাত্রা: সহমর্মিতা এবং সংযম। এক দিকে, বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াইবার দায় স্বীকার করিয়া প্রয়োজনীয় কর্মকাণ্ডে উদ্যোগী হইবার দায়িত্ব পালন করা জরুরি। ভরসার কথা, সেই কাজে বহু মানুষ ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক উদ্যোগে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন, তাঁহাদের দৃষ্টান্তে ও প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হইয়া আরও অনেকে এই সব কর্মকাণ্ডের শরিক হইতেছেন, বহু মানুষ যথাসাধ্য— অনেকেই সাধ্যের বাহিরে গিয়া— আর্থিক ও অন্যবিধ সাহায্য করিতেছেন। বিশেষ ভাবে আশা জাগায় তরুণ প্রজন্মের সহৃদয় ও সক্রিয় তৎপরতা, বিপন্ন মানুষের সহায় হইবার বহু উদ্যোগে অগ্রণী হইয়াছেন তরুণতরুণীরাই। সেই সহযোগিতাকে তাঁহারা আপন সামাজিক দায় হিসাবেই স্বীকার করিয়াছেন। ই সব উদ্যোগের সহিত আত্মপ্রচারের কিছু তাড়নাও হয়তো মিশিয়া যাইতেছে, কিন্তু এই ক্রান্তিকালে তাহা আক্ষরিক অর্থেই নগণ্য। আর, বাস্তববোধের খাতিরেই ওই খাদটুকুকে সহজে গ্রহণ করিতে হইবে— খাঁটি সোনায় গহনা হয় না।
কিন্তু দায়িত্বের দ্বিতীয় মাত্রাটি? নাগরিকের আত্মসংযম? সংক্রমণ রোধে যাহা শুরু হইতেই প্রয়োজনীয় ছিল, কিন্তু সরকারি বিধিনিষেধের বেড়ি শিথিল হইবার সঙ্গে সঙ্গে যাহার প্রয়োজন উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে? ‘আনলক’ পর্বে যে প্রয়োজন বহু গুণ বাড়িবে? আশঙ্কার কথা, আত্মসংযমের পরিবর্তে বহু ক্ষেত্রে যাহা দেখা যাইতেছে তাহার নাম অসংযম। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখিবার কথা সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইয়া মানুষ যথেচ্ছ ভিড় জমাইতেছেন, বাজারে লোক ভাঙিয়া পড়িতেছে, আড্ডার আসর বসিতেছে, অনেকেই মাস্ক পরিতেছেন না, আরও অনেকে— এমনকি উচ্চাসনে বসিয়াও— সেটিকে মালা করিয়া গলায় ঝুলাইয়া রাখিতেছেন। সব মিলাইয়া এক বেপরোয়া মানসিকতার প্রদর্শনী চলিতেছে। সমস্ত অনিয়মের জন্য নিশ্চয়ই মানসিকতাকে দায়ী করা চলে না, অন্য কারণও আছে। যথা যানবাহনের ঘাটতি— বহু মানুষ নিরুপায় হইয়াই ভিড় বাসে বা অন্য যানে সওয়ার হইতেছেন। কিন্তু সাধারণ ভাবে বলা চলে, বহু নাগরিকই সংক্রমণ রোধে আপন দায় সম্পর্কে সচেতন নহেন। তাঁহাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণে সেই অ-চেতনারই প্রমাণ মিলিতেছে। দেখিয়া শুনিয়া ফেলুদা বলিতেন, ‘ভাল লাগছে না রে তোপসে।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy