মাঠপালুনি উৎসবে শামিল মহিলারা। ছবি: কল্যাণ আচার্য
এক সময় ছিল পার্শ্ববর্তী জেলার প্রচলতি বিশ্বাস। এখন জেলার বহু জায়গায় তা হয়ে উঠেছে পালনীয় রীতি। কোন বাধ্যবাধকতা নেই, নেই প্রয়োজনও। তবুও লাগোয়া বর্ধমান জেলার প্রায় দুই শতাধিক বছরের একটি প্রচলিত বিশ্বাস বীরভূমের বহু জায়গায় হয়ে উঠেছে পালনীয় রীতি। ওই রীতি ঘিরে বছরের পর বছর ধরে উৎসবে মেতে ওঠেন বহু মানুষ। বিশেষত গৃহবধূ তথা মহিলারা। উৎসবটির নাম মাঠপালুনি উৎসব। চৈত্রমাসে ওই উৎসব হয়।
প্রচলিত রয়েছে, প্রায় দুই শতাধিক বছর আগে বর্ধমানের কোশিগ্রামে চৈত্র মাসে মড়ক দেখা দেয়। তখন এক ফকির নাকি গ্রামবাসীদের বলেন, একটা দিন গ্রামবাসীরা নিজেদের বাড়িতে রান্না না করে গ্রামের বাইরে কোথাও একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলেই মড়ক দূর হবে। তাঁর কথা অনুযায়ী, একদিন গ্রামবাসীরা সবাই হাঁড়িকুঁড়ি নিয়ে গিয়ে গ্রামের বাইরে রান্নাবান্না করে খাওয়াদাওয়া করেন। দিনভর সেখানেই কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরেন সকলে। তারপর থেকেই নাকি মড়ক দূর হয়ে যায়। সেই থেকেই ওই গ্রামের বাসিন্দারা ফকিরের নির্দেশ মেনে চৈত্র মাসের একটা দিন সবাই একসঙ্গে গ্রামের বাইরে কাটাতে শুরু করেন।
পরবর্তীকালে বর্ধমান লাগোয়া লাভপুর এবং নানুরেরও বিভিন্ন এলাকায় ওই রোগ দেখা দেয়। ওইসব এলাকায় বর্ধমানের আত্মীয়দের মুখে মুখে সেই ফকিরের নির্দেশের কথা ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই নির্দেশের কথা শোনার পর লাভপুর এবং নানুরের ওইসব গ্রামের বাসিন্দারাও বর্ধমানের কোশিগ্রামের অনুকরণে চৈত্র মাসের ২ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত শনি কিংবা মঙ্গলবারে একত্রে গ্রামের বাইরে কাটানো শুরু করেন ।
আজ আর সেই মড়ক নেই। সেই অর্থে সেদিনের মতো নেই চিকিৎসার সুযোগের অভাবও নেই। কিন্তু সেই প্রথাটা আজও টিকে রয়েছে। আজও গ্রামের বাইরে কোনও দেবস্থল কিংবা নির্জন গাছতলায় এক বা একাধিক গ্রামের মহিলারা মাঠপালুনিতে অংশ নেন। বহু গ্রামে কার্যত ওই প্রথাই এখন উৎসবের রূপ নিয়েছে। কোথাও উৎসব উপলক্ষে অস্থায়ী দোকানপাটও বসে যায়। ওই উৎসবই এখন মাঠপালুনি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। এখন আর পুরুষেরা বাড়ি ছেড়ে যান না ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশ গ্রামেরই মাহিলাদের চৈত্র মাসের নির্ধারিত দিনগুলিতে ওই উৎসবে সামিল হতে দেখা যায় ।
কেমন সেই উৎসব? বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, ওই উৎসব পালনের জন্য পুরুষানুক্রমে গ্রামের বাইরের কোন একটি ফাঁকা জায়গা এবং দিন ধার্য করা রয়েছে। আগে নির্ধারিত দিনটিতে কোনও পরিবারে রান্না হত না। কোশিগ্রামের মতোই হাঁড়িকুড়ি নিয়ে গিয়ে নির্ধারিত জায়গায় রান্নাবান্না করে খাওয়া হতো। কার্যত পিকনিকের মেজাজে সারাদিন সেখানে কাটিয়ে সন্ধ্যার মুখে বাড়ি ফিরে আসতেন সবাই। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সামিল হতেন সেই উৎসবে। এখন পুরুষরা ওই উৎসবে সামিল হন না। তাঁরা বাড়ি পাহারায় থাকেন। তাই তাঁদের জন্য রান্না করা হয়। কিন্তু অধিকাংশ পরিবারে মহিলারা ওই উৎসবে যোগ দিতে বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত কেউ মুখে কুটোটি পর্যন্ত কাটতে পারেন না। রান্না সেরে মহিলারা দই, চিঁড়ে, কলা, মিস্টি আর পানীয় জল নিয়ে বেরিয়ে যান নির্ধারিত জায়গায়। তারা বেড়িয়ে যাওয়ার পর পুরুষ এবং বাচ্চাদের উপোষ ভাঙে।
আর মহিলারা বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া ওইসব খাবার গোল হয়ে বসে ভাগ করে খান। দিনভর গল্পগুজব করে সন্ধ্যের মুখে বাড়ি ফেরেন তারা। ফেরার পর নিজের বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরিবারের কর্ত্রীরা প্রশ্ন করেন, “ গৃহিনী গৃহিণী ঘরে কেন এত আলো”। বাড়ির ভিতর থেকে গৃহকর্তারা উত্তর দেন, “গৃহিণী গিয়েছেন মাঠপালুনিতে , তাই বাড়ির সবাই আছে ভালো”। তারপর গৃহকর্তাকে কর্ত্রীর পা ধুইয়ে দিয়ে অতিথি বরণের মতো বাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। পাশাপাশি সদর দরজা থেকে বাড়ির ভিতর পর্যন্ত দিতে হয় জলের ধারাও।
বছরের পর বছর ধরে ওই ভাবেই চলছে মাঠপালুনি উৎসব। বিভিন্ন গ্রামের মহিলাদের নির্ধারিত কোনও জায়গায় সামিল হতে দেখা যায় মাঠপালুনি উৎসবে। ঘটনা এমনও ঘটে কোনও কোনও পরিবারে তিনটি প্রজন্ম অর্থাৎ শাশুড়ি, বৌমা এবং নাতবৌ কিংবা নাতনিকেও সামিল হতে দেখা যায়। এজন্য মাস খানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় আলোচনা। নির্ধারিত দিনে সবাই মিলে হাতে হাতে পুরুষদের জন্য রান্না করে দিয়ে দল বেঁধে মাঠপালুনি উৎসবে সামিল হতে বেড়িয়ে পড়েন। দুর্গাপুজোর মতোই মাঠপালুনি উৎসবে যোগ দিতে বাপেরবাড়ি আসেন বিবাহিত মহিলারাও। এমনকি যেসব জায়গায় ওই উৎসবের চল নেই সেইসব জায়গার আত্মীয়ারাও মাঠপালুনি উৎসবে যোগ দেওয়ার জন্য হাজির হন। উৎসবে যোগদানকারী মহিলাদের মধ্যে অনেকেই কবে কী উপলক্ষে ওই উৎসব চালু হয়েছিল তা জানেন না। তবুও বছরের পর বছর ধরে সামিল হন মাঠপালুনি উৎসবে। আসলে ওইসবের মধ্যেই পিকনিকের মেজাজে একটা দিন কাটানোর সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না তাঁরা।
মাঠপালুনি উৎসব ঘিরে কিছু কিছু জায়গায় একদিনের ছোটখাটো মেলাও বসে যায়। যেসব বাচ্চারা নাছোড়বান্দা হয়ে মা-ঠাকুমাদের সঙ্গে উৎসবস্থলে যায় তারা মেলা দেখে বেড়ায়। আর যারা বাড়িতে থাকে তাদের জন্য মায়েরা কিছু কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। সেই প্রলোভন দেখিয়েই তাদের বাড়িতে রেখে আসেন মায়েরা। মাঠপালুনি উৎসব উপলক্ষে একদিনের মেলায় ব্যবসায়ীরাও কিছু বিক্রিবাটার সুযোগ পান।
বেশ কিছু মহিলার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, একসময় পুরুষেরাও ওই উৎসবে সামিল হতেন। এখন বিভিন্ন কারণে পুরুষেরা আর যান না বটে, কিন্তু মহিলাদের উৎসাহিত করেন। সেই কারণেই মাঠপালুনি তাদের কাছে একটা উৎসবে পরিণত হয়েছে ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy