Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
সুদের হার কমছে কেন
Economy

সুদ কমলে ক্ষতি সাধারণ মানুষের, লাভ উদ্যোগপতিদের

নিম্নগামী রেপো রেট ব্যাঙ্কের সুদের ওপর একটা নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করে। রেপো রেট কমে গেলে ব্যাঙ্কগুলোর সামনে কম সুদে ধার পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়।

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:২০
Share: Save:

কয়েক বছর ধরে সুদের হার ক্রমাগত কমছে। যে সুদে ব্যাঙ্ক বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো টাকা ধার দেয় সেটা যেমন কমছে, তেমনই ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখলে যে সুদটা পাওয়া যায়, সেটাও কমছে। সুদ কমার প্রভাব সার্বিক ভাবে অর্থনীতির ওপর অবশ্যই পড়ছে, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এই প্রভাব সমাজের সমস্ত শ্রেণির ওপর সমান ভাবে পড়ছে না। বয়স্ক নাগরিক, যাঁরা তাঁদের বিগত কর্মজীবনের সঞ্চয় ব্যাঙ্কে রেখে তার সুদে সংসার চালাচ্ছেন, সুদ কমে যাওয়ার ফলে তাঁদের নাভিশ্বাস উঠছে। উল্টো দিকে, যে সব অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে সদ্য কর্মজীবনে প্রবেশ করার পর নতুন সংসার পেতেছেন, ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার নিয়ে বাড়ি-গাড়ি-ফ্রিজ-টিভি কিনেছেন, অস্বীকার করার উপায় নেই, সুদ কমে যাওয়ার ফলে তাঁদের কিছু সুবিধে হচ্ছে। একই ভাবে, যাঁরা ভবিষ্যতের জন্য টাকা জমাচ্ছেন, তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন; যাঁরা টাকা ধার করে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন বা ঋণ নিয়ে সন্তানদের উচ্চশিক্ষার খরচ সামলাচ্ছেন, তাঁদের উপকার হচ্ছে। একটা প্রশ্ন এখন সবার মনেই ঘুরছে। কোভিড-সঙ্কটের ফলে সুদের হার কি আরও অনেক কমে যাবে?

অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও সুদের হার ধার্য করে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক, অর্থাৎ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া। একেবারে পুরোপুরি ঠিক করে দেয় তা নয়, সুদের হারের একটা গণ্ডি বেঁধে দেয়— যার ভেতরে থেকে যে কোনও ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার সুবিধেমতো সুদের হারটা বেছে নিতে পারে। তাই ব্যাঙ্কগুলোর সুদের হারের মধ্যে খানিকটা তফাত থেকেই যায়। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটা আর্থিক নীতিনির্ধারক কমিটি আছে। তিন মাস অন্তর মিটিং করে তারা সুদের হার নির্ধারণ করে। বস্তুত, তিন মাস অন্তর দু’-দুটো সুদের হার নির্ধারণ করে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক, একটার নাম রেপো, অন্যটা রিভার্স রেপো। রেপো রেটে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলোকে টাকা ধার দেয়, আর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলো তাদের বাড়তি নগদ রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে জমা রাখলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক তাদের সুদ দেয় রিভার্স রেপো রেটে। রেপো এবং রিভার্স রেপো সাধারণত একসঙ্গে বাড়ে-কমে, একটা বাড়লে আর একটাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যদিও দুইয়ের মধ্যে একটা ফারাক থেকেই যায়।

নিম্নগামী রেপো রেট ব্যাঙ্কের সুদের ওপর একটা নিম্নমুখী চাপ সৃষ্টি করে। রেপো রেট কমে গেলে ব্যাঙ্কগুলোর সামনে কম সুদে ধার পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দেয়। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে কম সুদে ধার পাওয়া গেলে ব্যাঙ্কগুলো সাধারণ আমানতকারীদের বেশি সুদ দেবে কেন? ফলে ব্যাঙ্কে আমানতের ওপরেও সুদ কমে যায়। আর আমানতের ওপর সুদ কমে গেলে ব্যাঙ্কগুলো নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে ঋণের ওপরেও সুদ কমিয়ে দেয়। এই ভাবে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির আমানত এবং ঋণ, দুইয়ের সুদই নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এখন সুদ কমে যাওয়ার দায়িত্ব রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককেই নিতে হবে।

সুদ কমিয়ে দেওয়ার পিছনে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতিনির্ধারক কমিটি সাধারণত তিনটি যুক্তি দিয়ে থাকে। প্রথমত বলা হয়, সুদের হার কমলে কম সুদের সুবিধে নিয়ে উদ্যোগপতিরা ধার করে নতুন যন্ত্রপাতি কিনবেন, বাড়তি লোক নিয়োগ করবেন, তাঁদের ব্যবসাপত্র বাড়াবেন। অর্থাৎ এক কথায়, সুদের হার কমলে বিনিয়োগ, উৎপাদন এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। দ্বিতীয় যুক্তি, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে সুদের হার অনেক বেশি, তাই একে আন্তর্জাতিক স্তরে নামিয়ে আনা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমাদের দেশে মূল্যবৃদ্ধির হার কমছিল। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বক্তব্য, সেই কমে আসা মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুদের হার কমানো হয়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে সুদের হারকে কেন যুক্ত করা হচ্ছে? ধরা যাক, একশো টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে এক বছর পরে একশো ছয় টাকা পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ বার্ষিক সুদের হার ছয় শতাংশ। কিন্তু যদি দেখি, একশো টাকা দিয়ে যে জিনিসগুলো এখন কেনা যেত, এক বছর পরে সেগুলো কিনতে একশো সাত টাকা লাগছে, অর্থাৎ মূল্যবৃদ্ধির হার সাত শতাংশ, তা হলে ধরে নিতে হবে, সুদ হিসেবে প্রকৃত অর্থে কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না, বরং এক বছর পরে সুদে-আসলে যেটা পাওয়া যাচ্ছে, তার মূল্য এখনকার একশো টাকার চেয়ে কম। এর মানে হল, প্রকৃত সুদের হার, যেটা আর্থিক সুদের হারের থেকে মূল্যবৃদ্ধির হারকে বিয়োগ করলে পাওয়া যায়, সেটা এ ক্ষেত্রে ঋণাত্মক। অর্থাৎ, আর্থিক সুদের হারের দিকে না তাকিয়ে আমাদের উচিত প্রকৃত সুদের হারের দিকে তাকানো।

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক ঠিক সেটাই করছে। প্রকৃত সুদের হার স্থিতিশীল রাখতে গিয়ে মূল্যবৃদ্ধির হার যখনই কমছে, তারা আর্থিক সুদের হারকেও কমিয়ে দিচ্ছে। তাই ভারতে প্রকৃত সুদের হার আন্তর্জাতিক হারের থেকে এখন আর খুব একটা আলাদা নয়। তবে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, গত কয়েক বছর ধরে ভারতে শুধু আর্থিক হার নয়, প্রকৃত সুদের হারও একটু একটু করে কমেছে। অর্থাৎ, মূল্যবৃদ্ধির হার যতটা কমেছে, তার থেকে বেশি কমেছে আর্থিক সুদের হার। হয়তো প্রকৃত সুদের হার কমলে বিনিয়োগ বাড়বে, এই প্রত্যয় সুদ কমানোর পিছনে কাজ করেছে। কিন্তু, প্রকৃত সুদের হার কমার ফলে সত্যিই বিনিয়োগ বেড়েছে কি না, তা নিয়ে ঢের সংশয় আছে। যেটা জোর দিয়ে বলা যায়, প্রকৃত সুদের হার কমার ফলে উদ্যোগপতিদের খরচ কমেছে, ফলে তাঁদের মুনাফাও সুরক্ষিত হয়েছে। এবং এটা ঘটেছে সঞ্চয়কারীদের, বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিকদের, স্বার্থহানি করে, তাঁদের প্রকৃত আয় কমিয়ে দিয়ে। তা ছাড়া, প্রকৃত সুদের হার ক্রমাগত কমে যাওয়ার ফলে সাধারণ সঞ্চয়ীদের কেউ কেউ শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তার দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে, শেয়ারের দাম বেড়েছে, যার সুফল পেয়েছেন মূলত উদ্যোগপতিরা, যাঁরা বড় বড় কোম্পানির অধিকাংশ শেয়ারের মালিক।

এ বার কোভিড সঙ্কটের প্রসঙ্গে আসি। কোভিড সঙ্কট শুরু হওয়ার পর রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের আর্থিক নীতিনির্ধারক কমিটি এখন অবধি দু’টি মিটিং করেছে। গত মে মাসের শেষ দিকে তারা যে মিটিং করে, তাতে রেপো এবং রিভার্স রেপো; দুটোই কমানো হয়। রেপো রেট ৪.৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করা হয়, রিভার্স রেপো ৩.৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করা হয় ৩.৩৫ শতাংশ। স্মরণ করা যেতে পারে, এর প্রভাবে ব্যাঙ্কের সুদের হার কমে গিয়েছিল। তবে অগস্টের শুরুতে আর্থিক নীতিনির্ধারক কমিটির যে সাম্প্রতিকতম মিটিং হয়েছে, সেখানে রেপো এবং রিভার্স রেপো দুটো হার অপরিবর্তিত আছে। ধরে নেওয়া যায়, অন্তত মাস তিনেক সাধারণ আমানতকারী এবং ঋণগ্রহীতাদের আর্থিক সুদের হারে বড়সড় পরিবর্তন হবে না।

কিন্তু আর্থিক সুদের হার অপরিবর্তিত থাকলেও সম্প্রতি মূল্যবৃদ্ধির হার অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। জাতীয় পরিসংখ্যান দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে খুচরো বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৬ শতাংশ— ব্যাঙ্কগুলো তাদের স্থায়ী আমানতে যে সর্বোচ্চ সুদ দিচ্ছে, তার থেকে বেশি। অর্থাৎ, আমানতকারীরা তাঁদের আমানতের ওপর এখন যে প্রকৃত সুদটা পাচ্ছেন, সেটা শূন্যের নীচে নেমে গিয়েছে। ব্যাঙ্কঋণের ওপর দেয় প্রকৃত সুদের হারও চলে এসেছে শূন্যের কাছাকাছি।

প্রকৃত সুদ কমে যাওয়ার বর্তমান প্রেক্ষিতটা কিন্তু আগের থেকে আলাদা। কোভিড সঙ্কটের ফলে বিনিয়োগের ওপর মুনাফার হার এখন তলানিতে ঠেকেছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সুদ দেওয়া দূরের কথা, ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ করাই সম্ভব হচ্ছে না। প্রকৃত সুদের ওপর এর প্রতিফলন ঘটছে। অন্য ভাবে দেখতে গেলে, অতিমারির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ হচ্ছে না বলে ব্যাঙ্ক থেকে খুব বেশি লোক ধার নিচ্ছেন না। ফলে ব্যাঙ্কগুলোর ঘরে প্রচুর নগদ জমে যাচ্ছে। ব্যাঙ্কগুলো এই নগদ রিভার্স রেপোতে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখছে। প্রকৃত সুদের হার না কমলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক এই বোঝা বহন করবে কী করে?

এই সমস্যার হাত থেকে বেরনোর একটা উপায় আছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি বাজার থেকে আরও ঋণ নেয়, তা হলে বাজারে ঋণের চাহিদা বাড়বে। বাজার থেকে ঋণ নিয়ে কেন্দ্র দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে বিনিয়োগ করলে, এক দিকে যেমন সরাসরি কর্মসংস্থান তৈরি হবে, তেমনই অন্য দিকে ব্যাঙ্কগুলোর বাড়তি নগদের বোঝা খানিকটা কমবে। প্রকৃত সুদের হারও স্থিতিশীল হবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy