নাগরিকতা-যজ্ঞ: ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য বিধিভুক্ত হওয়ার পর প্রতিবাদের আগুন, দিল্লি, ১১ ডিসেম্বর। পিিটআই
মানুষ নিশ্চয়ই খুশি? ভারতের মানুষ? হওয়ারই কথা। মুসলিমদের তবে এত দিনে ভারতের নাগরিক সমাজ নামক মঞ্চটায় স্বাভাবিক স্বীকৃতির আসনটা থেকে টেনে নামিয়ে দেওয়া গিয়েছে। ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’ ইত্যাদি নয়, সরাসরি তাঁদের নাগরিকত্বের অধিকার কতটা, প্রশ্নটা তা নিয়েই তোলা গিয়েছে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সকলের, দেশব্যাপী সকলের, খুশি হওয়াটা জরুরি। বিপুল ভোটবৃষ্টিতে যাঁদের জেতানো হয়েছিল, তাঁরা তাঁদের লক্ষ্য পূরণ করেছেন। মানুষের মতদান সার্থক হয়েছে। এত বিরাট সংখ্যক মানুষকে বিপদের মুখে ফেলা গিয়েছে, দেশের সংবিধানের অন্তর্নিহিত ভাবনাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক আইন বানানো হয়েছে, বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে ভারত বলতে এত দিন যে যা বুঝে থাকুন না কেন সে সব এ বার ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে, এ দেশ এখন একটা অন্য দেশ। মানুষ খুশি হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের দুই মুখ অমিত শাহ ও নরেন্দ্র মোদীর উপর পুষ্পবৃষ্টি করুন— আমাদের দেশের বহু সমস্যা বহু সঙ্কটের মধ্যে দাঁড়িয়ে এটাই, ঠিক এটাই, না করলে আমাদের সমস্যা সমাধান হচ্ছিল না। আমরা তো জানিই, এ দেশের সর্ববিধ সমস্যার মূলে আছে মুসলমানেরা।
পরম লগ্ন যাকে বলে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এ দেশে আজ নতুন স্বর্ণসূর্য উঠছে, নব আনন্দে জাগো নব রবিকিরণে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজ্যসভায় সগর্জনে বলেছেন, লক্ষ্য পূর্ণ হল, গোটা পৃথিবী থেকে যদি মুসলমানেরা এসে এ দেশের নাগরিকত্ব চাইলে যে তা দেওয়া সম্ভব নয়, পরিষ্কার করা গিয়েছে। সঙ্গে এও জুড়ে দিয়েছেন যে, ভারতীয় মুসলমানদের কোনও ভয় নেই। তাঁর এই দুটো বাক্যের মধ্যবর্তী ফাঁকটা আসলে একটা সুবিস্তৃত খাদ— হিন্দু মুসলিম কারওই তা বুঝতে অসুবিধে নেই। সেই অনুক্ত ফাঁদটা হল: ভারতে বসবাসকারী মুসলমান প্রমাণ দিন যে তিনি বৈধ বসবাসকারী ‘ভারতীয় মুসলিম’।
কী করে সেই প্রমাণ দেওয়া যাবে? সেটা অতল অনিশ্চয়তার গহ্বরে। বিশেষত যে ‘ফাঁক’টা গত দুই দিন নাগরিকত্ব বিল বিষয়ক তর্কগর্জনে লক্ষণীয় ভাবে অনুচ্চারিত রইল— তার নাম এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি। এই অনুচ্চারণের গূঢ় অর্থ সামান্য বুদ্ধিতেই বোঝা সম্ভব। বোঝা সম্ভব, ‘ক্যাব’ নামক প্রত্যক্ষত বৈষম্যমূলক বিলটি কেন এত জরুরি ভিত্তিতে টেবিলে আনা দরকার হল।
দেশে যে নাগরিক পঞ্জি তৈরি করা হচ্ছে, ভাবা হয়েছিল তাই দিয়ে মুসলিমদের আলাদা করে ফেলা যাবে। কিন্তু না, সেটা হল না। নাগরিক পঞ্জিতে নাম ওঠানোর কাজটা দেখা গেল বিপুল রকম এলোমেলো, অনিশ্চিত। অসমের মতো যে প্রদেশে সত্যিই প্রতিবেশী দেশ থেকে বেআইনি ভাবে হাজার হাজার মানুষ এসে ভিড় জমান, সেখানেও নাগরিক পঞ্জির ছাঁকনি দিয়ে মুসলিমদের আলাদা করা গেল না। ১৯ লক্ষ তালিকাবহির্ভূতের মধ্যে ১২ লক্ষই দেখা গেল হিন্দু। এমতাবস্থায়, জরুরি হয়ে পড়ল আরও একটা মুসলিম-ধরা ছাঁকনি— সেটাই হল নাগরিকত্ব বিল, থুড়ি, আইন।
কাজটা সহজ নয়। এনআরসি-তে যাঁরা বাদ গেলেন, তাঁদের অনেকেই বৈধ, সঙ্গত ও পূর্ণ ভাবে এ দেশেরই মানুষ। কিন্তু অসমের অভিজ্ঞতা আর একটাও দরকারি শিক্ষা দিয়ে গেল। আসল কথাটা তো এই যে, ‘গোটা পৃথিবী থেকে’ মুসলমানেরা ভারতে থাকতে আসেন না, এমনকি পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকেও খুব নামমাত্র মানুষ ভারতে এসে পাকাপাকি ভাবে থাকতে চান। আসেন কেবল বাংলাদেশের মানুষই। অর্থাৎ প্রথমে অসম, তার পর পশ্চিমবঙ্গ, এই হল এত বড় দেশজোড়া এনআরসি তথা ‘ক্যাব’-যজ্ঞের লক্ষ্য। মুশকিল হল, বাংলাদেশ থেকে কেবল মুসলিম আসেন না, হিন্দুরাও আসেন! এনআরসি-র ছাঁকনিতে যে সেই হিন্দুরাও ধরা পড়ছেন। তা হলে চলবে কী করে, হিন্দুদের খুশি করাটাই না দরকার? তাঁদের ভোটটাই না দরকার? সুতরাং ‘লাও ক্যাব’। ২০২১ সাল এসে পড়ল বলে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের শিঙা বাজল বলে। এই বেলা দ্রুত ‘মুসলিম মানে অনুপ্রবেশকারী’ ও ‘হিন্দু মানে শরণার্থী’ ভাগাভাগিটা শুরু করা চাই। পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দুরা যাতে অসমের হিন্দুদের মতো চটে না যান, বেদম খুশি হন, সেটা দেখা চাই! না হলে এই মুহূর্তে দেশে শরণার্থী নিয়ে এত ভাবনাচিন্তার দরকার ছিল না, যে সব আইন ইতিমধ্যেই আছে, তাই দিয়েই বেআইনি লোকজনকে বেআইনি ঘোষণা করা খুবই সম্ভব ছিল। কিন্তু নাগরিকত্ব আইনের মূল লক্ষ্য তো বেআইনি লোকজন ধরা নয়, লোকজনের মধ্যে ভাগাভাগি করা, যাকে বলে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’!
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল-এর আলোচনায় এই ভাগটা করার জন্যই প্রতিবেশী দেশের ‘ধর্মীয় নির্যাতন’-এর বিষয়টা নিয়ে আসা। কিন্তু প্রতিবেশী দেশে ধর্মীয় নির্যাতনের কথা বললে তো আবার পাকিস্তানের মোহাজির বা আহমদিয়া বা শিয়ারাও ‘শরণার্থী’র দলে ঢুকে পড়েন? মায়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরাও? না, তাঁদের আটকাতে হবে। নির্যাতন-পরবর্তী ‘শরণার্থী’ দলে মুসলিমদের ঢোকানো যাবে না। তাই পষ্টাপষ্টি বলতে হল, ভারতে জায়গা পাবে কেবল পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দুরা, কিংবা জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি, খ্রিস্টানরা— মুসলিমরা নয়। আর মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের তো ভারতে জায়গা হবেই না, কেননা তাঁরা বাংলাদেশ নামক একটি ‘মুসলিম’ দেশের মধ্যে দিয়ে ভারতে এসেছেন।
‘মুসলিম দেশের মধ্য দিয়ে এলে হবে না’, যুক্তিটা লক্ষণীয়। কেননা, এর মাধ্যমেই বলে দেওয়া হল, মুসলিমরা যেন কোনও মুসলিম দেশেই থেকে যান, ভারতের মতো ‘অমুসলিম দেশ’ বা ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ ঢোকার সাহস যেন না দেখান।
সমস্যা এখানেও থামল না। বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুরা যে ‘ধর্মীয় নির্যাতন’-এই এসেছেন, কী ভাবে তা প্রমাণ করা যাবে? নির্যাতনের কি কিছু কাগজপত্র থাকে? এনআরসি-র সময় তো দেখাই গিয়েছিল, সে দেশ থেকে আসা হিন্দুদের অধিকাংশেরই কোনও নথিপত্র নেই, আগমনকারী মানুষের কাছেও নেই, বাংলাদেশ সরকারের কাছেও নেই। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালেই ব্যাপারটা পরিষ্কার। কে কবে এসেছেন, কী ভাবে এসেছেন, কিছুরই প্রমাণ দেখাতে পারেন না এই মানুষেরা। সুতরাং অতীব গুরুত্বপূর্ণ— যদিও এই বিলের আগের সব খসড়ায় ‘নির্যাতন’ (পারসিকিউশন) শব্দটা ছিল, যখন এই সপ্তাহে বিল আইনে পরিণত হল, তার চূড়ান্ত খসড়ায় কিন্তু ওই শব্দটা উঠিয়ে নেওয়া হল। স্বাভাবিক। হিন্দুরা ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’ এসে পড়লেও তাঁদের আবার নথিপত্র দেখাতে বলা মানে তাঁদের বিপদে ফেলা— এনআরসি যখন দেখিয়েই দিয়েছে হিন্দুদের বাদ যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা।
একটা গভীরতর কথাও আছে। যে হিন্দুরা এনআরসি–তে বাদ পড়ছেন, তাঁরা তো এর আগে প্রত্যেকেই প্রাণপণ প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যে ভিত্তিবর্ষ বা ‘কাট-অফ’ বছরের আগেই তাঁরা এসে পৌঁছেছেন। এখন আবার ‘ক্যাব’-এর মাধ্যমে স্বীকৃত হওয়ার জন্য তাঁরা কী করেই বা বলবেন যে, আগে ভুল বলেছি, ভিত্তিবর্ষের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে ‘নির্যাতন’ সহ্য করেছেন বলেই আজ তাঁরা ভারতের শরণার্থী? হয় তাঁদের আগের কথাটা মিথ্যে, নয় এখনকার কথাটা মিথ্যে! এই প্যাঁচ থেকে বেরোনোর জন্য ‘নির্যাতন’ শব্দটাকেই শেষ মুহূর্তে বাদ দিতে হল। বলতে হল, হিন্দুরা (এবং অন্য অমুসলিমরা) এলেই তাঁরা শরণার্থী, প্রমাণ চাই না। অর্থাৎ নাগরিকত্ব চাইবার অধিকার সকল অমুসলিমদের। মুসলিমরা প্লিজ় নাগরিকত্বের আশা করবেন না।
রব উঠেছে, এই আইন অসাংবিধানিক। উল্টো রবও উঠেছে যে, সংবিধানে কী আছে কী নেই, সে সবই কি মুসলিম-প্রেমী ‘সিকুলার’রা বুঝে ফেলেছেন? তাঁরা যেন মনে রাখেন, সংবিধান ও আইন থেকে ‘রিজ়নেবল ক্লাসিফিকেশন’ ইত্যাদি যুক্তিতর্ক যথাসময়ে নামানো যাবে, যথাস্থানে নিশ্চয় প্রমাণও করা যাবে, চিন্তার কারণ নেই। আপাতত শান্তিকল্যাণে থাকুন— মুসলিমদের বাড় বেড়েছিল, তাদের শিক্ষা দেওয়া গিয়েছে।
বাস্তবিক, যাঁরা আইনকানুন নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা জানেন, ‘রিজ়নেবল’ বা ‘যুক্তিসঙ্গত’ শব্দটির ফাঁকে কত কী ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব। কত অযুক্তি, কত ফাঁকি, কত বৈষম্যকে সুনিপুণ উপায়ে নির্বিষ চেহারা দেওয়া সম্ভব। সেই জায়গাটা তর্ক করে জেতার আশা যাঁরা করছেন, সম্ভবত বোকামি করছেন। বিশেষত আজকের সময়ে যেখানে বিচারের বাণীর মধ্যে সাম্য ও অধিকারের প্রশ্ন প্রায়ই নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলে।
আসলে এটা কোনও সাংবিধানিকতা বা আইনবিচারের প্রশ্ন নয়। রাজনীতির প্রশ্ন। রাজনীতিকে ঠিক ভাবে ব্যবহার করলে এই সবই পাল্টে দেওয়া চলে। খুব দ্রুতই তা করা চলে। বর্তমান ভারতীয় সরকার সে দিক দিয়ে একটি অ-সামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। সংবিধান বা আইনকানুন কী ভাবে দ্রুত পাল্টিয়ে দেওয়া যায় জোর খাটিয়ে, সংবিধানের ব্যাখ্যাকে কী ভাবে প্রভাবিত করা যায় জনভাবাবেগের যুক্তি দিয়ে, তা দেখাচ্ছে। এই জোর বা ভাবাবেগ, সবই নিশ্চিত করা হচ্ছে সংখ্যা দিয়ে। এবং সংখ্যা নিশ্চিত করা হচ্ছে রাজনীতি দিয়ে।
এই মুহূর্ত ভারতের পক্ষে ‘ঐতিহাসিক’। একটা অন্য ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে, যা বলছে, এখন থেকে গণতন্ত্রের মানে— সংবিধান নয়, সর্বস্বার্থ রক্ষা নয়— কেবল সংখ্যা। সেই সংখ্যা যা চাইবেন, তা-ই হবে। বাকি সব মায়া। ছলনা। অসার কল্পনা।
তাই বলছিলাম, সেই সংখ্যারা, মানে মানুষেরা, খুশি হয়েছেন তো? তাঁদের জন্যই তো এত সব!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy