যাহা খাইলে দুর্ভোগ, না খাইলে আক্ষেপ, সেই দিল্লির লাড্ডু খাইতে কেমন জানা নাই। তবে সংসারী মানুষের জীবনে তাহার স্থানটি লইয়াছে ‘কাজ।’ কাজ যাহার নাই, তাহার আফশোসের সীমা নাই। যাহার আছে, সে এড়াইতে পারিলে বাঁচে। কত অদ্ভুত কৌশলে মানুষ কাজের দিনেও ছুটির একটু স্থান করিয়া লয়, নির্দয় লোকে তাহাকে বলে ‘ফাঁকি।’ ওই ফাঁকটুকু না থাকিলে তাহার প্রাণবায়ু রুদ্ধ হইয়া আসে। উপনিষদের ঋষি বলিয়াছেন, কাজ করিয়াই শতবর্ষ বাঁচিতে ইচ্ছা করিবে। অমৃতের পুত্রকন্যারা সেই মন্ত্রদ্রষ্টাকে দূর হইতে গড় করিয়া, এক খিলি পান মুখে পুরিয়া বলে, ‘‘কাজ শেষ হইলে বাঁচি।’’ তবে দৈত্যকুলে যেমন প্রহ্লাদ, তেমনই মনুষ্যকুলে কিছু বিচিত্র জীব কাজ না করিলে বাঁচে না। তাহাদের তুমুল কর্মতৎপরতা দেখিয়া লোকে চমৎকৃত হইয়া বলে, ‘কাজের মানুষ বটে।’ এই প্রশংসায় কিঞ্চিৎ শ্লেষ কি মিশিয়া থাকে না? যাহারা একটু অবসর পাইলে ভাঙা বেড়া মেরামত করিতে বসে, শ্রীরামকৃষ্ণ তাহাদের প্রতি কঠিন বিদ্রুপ করিয়াছিলেন। পরমার্থচিন্তা এড়াইতেই সংসার-আসক্ত মানুষের এমন সদাব্যস্ততা, বলিয়াছিলেন তিনি। জীবনের কেন্দ্রে রহিয়াছে যে সকল সংশয়, তাহা আপন স্বরূপ লইয়াই হউক অথবা সমাজ-সংসারে কর্তব্য-অকর্তব্যের বিচার, কাজের বোঝা সরিলেই সেগুলি মাথা তুলিতে চায়। তখনই যেন পরিপাটি আলনাটি আবার গুছাইবার, পুরাতন হিসাব আরও একবার মিলাইবার নেশা পাইয়া বসে। ‘কাজের মানুষ’ বহু অর্থহীন কাজ করিয়া চলে, মানবজন্মের চিরকালীন প্রশ্নগুলি এড়াইতে।
তেমনই গোল বাধিয়াছে ‘মানুষের কাজ’ লইয়া। নির্বাচন আসিতেই নেতারা পরস্পর স্পর্ধা করিয়া মানুষের কাজ করিবার ঘোষণা করিতেছেন। সরল মনে কেহ হয়তো ভাবিতেছেন, কাজ তো আর কম পড়ে নাই, করিলেই হয়। তাহাদের মনে করিতে হইবে কাক্কেশ্বরের কথাটি, গরম লাগিলে তিব্বত যাইলেই হয়। ‘হযবরল’ কাহিনির সেই রাস্তাটি যেমন কলিকাতা হইতে ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট হইয়া তিব্বত যায়, রাজনীতিও চলে তেমনই ‘সোজা’ পথে। তাই বাড়ির পশ্চাতের বস্তিটিতে আলো-জল আনিতে হইলে দিল্লি-হাওড়া ঘুরিয়া আসিতে হয় নেতাদের। ক্ষমতা লাভের সেই পথের দুই পাশে ছিন্ন পাদুকার ন্যায় পড়িয়া আছে বহু রাজনৈতিক কর্মীর খণ্ডিত জীবন, ভগ্ন আশা। এই মানুষগুলি কোন কাজ করিতে চাহিয়াছিল, তাহাদের জন্যই বা কে কী করিয়াছে, কাহারও মনে নাই। দুই ধারে কত না নিরুৎসুক দর্শক। শাসক অথবা বিরোধী, কেহ তাহাদের ‘মানুষ’ বলিয়া মনে করে নাই। বহু আবেদন-আন্দোলন করিয়াও তাহাদের অতি-আবশ্যক কাজগুলি আদায় হয় নাই। তাহাদের নালিশ, নেতা নিজেই সেই ‘মানুষ’ যাহার জন্য এত কাজ। নির্বাচিত হইবার পর দেখিতে দেখিতে নেতার চুন-খসা বাড়ি হইয়া ওঠে মার্বেল-মণ্ডিত অট্টালিকা, হাসিম শেখ তখনও বাড়ি বানাইবার অনুদান পাইতে হাঁটিয়া হয়রান। রামা কৈবর্ত নিজের অনুদান হইতে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র নেতাকে ‘দান’ করিবার পর ধার করিয়া অ্যাসবেস্টস ছাউনি লাগাইয়াছে। মানুষের কাজের খতিয়ান এই সকল মুখের বলিরেখায় পড়িতে হইবে।
তবে নিষ্কাম প্রেমিক আর নিঃস্বার্থ নেতা কে-ই বা দেখিয়াছে? যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলিয়াছিলেন, গর্ভিণী মাতার গর্ভরক্ষার ন্যায় আপন প্রিয় কাজ ভুলিয়া নাগরিককে রক্ষা করিবে শাসক। বাস্তবে নেতা ও নাগরিক যেন অসুখী দম্পতি — একে অন্যকে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না, আক্ষেপেরও অন্ত নাই। বারবার ভয় হয়, এই বার বুঝি গণতন্ত্রের সাজানো সংসারটি ভাঙিল। নাগরিক সমাজে নানা স্বার্থের সংঘাত — কাহার জন্য নেতা কাজ করিবেন, সে তাঁহার নির্বাচন। শৌচাগার উদ্বোধন, খুঁটিপূজার আয়োজনে দিন কাটাইতে পারেন। অলস, ফাঁকিবাজ নেতাও ভোটে জিতিয়া আসেন। ক্ষতি নাই, নেতাও মানুষ। তবে ‘মানুষের জন্য’ কাজ না করিলেও, ‘মানুষের মতো’ কাজ করিবেন না কি? দুইটা ভোট পাইতে হিংস্র সংঘাত বাধাইয়া দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুলি মারিবার আস্ফালন, এই কি মানুষের কাজ? আজও ভারতে নেতাদের কথা প্রতিধ্বনিত হয় বহু মুখের কথায়। ‘মানুষের কাজ’ করিবার ঘোষণা যে মনুষ্যোচিত কাজ করিবার অঙ্গীকার, এই আশ্বাসটুকু মিলিলে দেশের মানুষ কিছু নিশ্চিন্ত হইতে পারে।
যৎকিঞ্চিৎ
এক জনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নাম পাল্টে দিত। তার ইলাহাবাদের নাম হয়ে গেল প্রয়াগরাজ, ফৈজ়াবাদের নাম অযোধ্যা, মুঘলসরাইয়ের নাম দীন দয়াল উপাধ্যায়, হায়দরাবাদ ভাগ্যনগর হল বলে। কিন্তু যেই না ড্রাগন ফ্রুটের নাম পাল্টে করেছে ‘কমলম্’, অমনি নেট-দুনিয়ায় হোহোহিহির চোটে মানসম্মান সব পড়ে গিয়েছে। কী ছবি দেখলি? ‘এন্টার দ্য কমলম্।’ ওই রেস্তরাঁর কমলম্ স্যুপটা খাস কিন্তু! এই সবই যে হ য ব র ল, সেই কবে দেখিয়ে গিয়েছেন সুকুমার রায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy