Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

সূর্যমুখী বংশের, গুণ শুধু নাইট্রোজেন তৈরিতে

পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পার্থেনিয়াম নেই। এর ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য মাঝে মাঝে সাফাই চলে। কিন্তু গুণও রয়েছে পার্থেনিয়ামের। লিখলেন দিগন্ত মান্না পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে পার্থেনিয়াম নেই। এর ক্ষতিকর প্রভাবের জন্য মাঝে মাঝে সাফাই চলে। কিন্তু গুণও রয়েছে পার্থেনিয়ামের।

এই দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও প্রান্তের। নিজস্ব চিত্র

এই দৃশ্য পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও প্রান্তের। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ০০:৩৭
Share: Save:

বহুদিনের চর্চায় এখন সকলেই জানেন তথ্যগুলো। দ্রুত ছড়ানো আগাছার আদি বাসভূমি মেক্সিকো। সেখান থেকেই এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দিয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ভারতে এর আগমন আমেরিকা থেকে আনা গমের সঙ্গে। ভারতে অনেকে এই আগাছাকে ‘কংগ্রেস ঘাস’ বলে থাকেন। প্রচলিত তথ্য, আমেরিকা থেকে আনা গমের গুণমান যাচাই না করেই তৎকালীন কংগ্রেস সরকার তা বিলি করে দিয়েছিল। ফলে সারা ভারত জুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে গাছটি। আগাছার অন্য নাম, ‘গাজর ঘাস’। কারণ, গাজরের মতো ফুল হয়।

এতক্ষণে নিশ্চয় চেনা গিয়েছে আগাছাটিকে? পার্থেনিয়াম। এটি একটি বর্ষজীবী বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম পার্থেনিয়াম হিস্টেরোফেরাস। পার্থেনিয়ামে রয়েছে পার্থেনিন নামক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান এবং এক ধরনের টক্সিন বা বিষ। যা ভীষণ ক্ষতিকর। তবে আগাছাটি জন্মসূত্রে সূর্যমুখী পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। আরও একটু চেনা যাক।

বিষাক্ত উদ্ভিদটি সাধারণত উচ্চতায় এক থেকে ১.৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। ধনে পাতার গাছের মতো দেখতে ছোট ছোট সাদা ফুলে ভর্তি এই গাছটি। পার্থেনিয়াম শাখা বিস্তারের মাধ্যমে গম্বুজ আকৃতির অথবা ঝোপ আকারের হয়। পাতা শাখাযুক্ত ত্রিভুজের মতো। নির্দিষ্ট বয়সে ফুল ফোটে। একটি গাছ বাঁচে তিন থেকে চার মাস। এই সময়ের মধ্যেই তিনবার ফুল ও বীজ হয়। গোলাকার, সাদা, আঠালো এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে এর ফুল। পার্থেনিয়ামের একটি গাছ ৫ থেকে ২৫ হাজার বীজ উৎপাদনে সক্ষম। এই বীজ এতই ছোট যে গবাদি পশুর গোবর, গাড়ির চাকার কাদামাটি, পথচারীদের জুতোর তলার কাদামাটি, সেচের জল ও বাতাসের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। চন্দ্রমল্লিকার পাতার মতো পার্থেনিয়ামের পাতার কিনারা গভীরভাবে খণ্ডিত। কাণ্ড হালকা রোমশ। পুষ্পমঞ্জরীর রঙ সাদা। তাতে অসংখ্য ছোট ছোট ফুল থাকে। এই ফুলের রেণু বাতাসের মাধ্যমে সহজেই দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এবং মানব দেহে চর্মরোগ (ডার্মাটাইটিস), জ্বর, হাঁপানি ও ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগ সৃষ্টি করে।

কী হতে পারে পার্থেনিয়াম থেকে? পার্থেনিয়াম মানুষের হাতে ও পায়ে লাগলে প্রাথমিক অবস্থায় হাত, পা চুলকোতে শুরু করে, লাল হয়ে যায়। পরে ত্বকে ক্যানসারও সৃষ্টি করতে পারে। পার্থেনিয়ামের কারণে ঘনঘন জ্বর হতে পারে। অসহ্য মাথাব্যথা ও উচ্চরক্তচাপে ভুগতে পারেন কেউ কেউ। দশ মিটার দূর থেকেও এই আগাছাটির ফুলের রেণু মানুষের এলার্জি, হাঁপানি রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়। পার্থেনিয়াম ভরা মাঠে গবাদি পশু চরলে পশুর শরীর ফুলে যেতে পারে। তীব্র জ্বর, বদহজম-সহ নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দুগ্ধবতী গরু, মোষ, ছাগল পার্থেনিয়াম খেয়ে ফেললে দুধ তেতো হয়ে যায়। সেই দুধ খাওয়া খুবই ক্ষতিকর। গবাদি পশু বেশি পরিমাণ পার্থেনিয়াম খেয়ে ফেললে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এই বিষাক্ত আগাছা এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে যা কীটপতঙ্গ ও ফসল উভয়ের ক্ষতি করে। পার্থেনিয়াম আগাছা জমিতে থাকলে ফসলের উৎপাদন প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যায়। পার্থেনিয়ামের রেণু বাতাসে মিশে ধান, ছোলা, সর্ষে, গম, টম্যাটো, লঙ্কা ও বেগুন গাছে ব্যাপক ক্ষতি করে। এই গাছ থেকে এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণের ফলে ডাল জাতীয় গাছের নাইট্রোজেন তৈরিতে সহায়তাকারী ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস হয়ে যায়।

কী ভাবে পার্থেনিয়াম দমন করা যায়? পার্থেনিয়াম গাছে কেরোসিন তেল ছিটিয়ে দিলে গাছ দ্রুত মারা যায়। তবে এতে অনেক অসুবিধাও রয়েছে। পদ্ধতিটি ব্যয় সাপেক্ষ। কেরোসিন জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়লে জল নষ্ট হতে পারে। তবে সহজ একটি ঘরোয়া উপায়ে পার্থেনিয়াম নিকেশ করা যায়। ৪-৫ লিটার জলে এক কেজি নুন ভাল করে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় ও পাতায় ছিটিয়ে দিলে দু’দিনের মধ্যে গাছ মারা যায়। এ ক্ষেত্রে ব্রোমাসিল, ডায়ইউরোন, টারবাসিল প্রতি হেক্টরে দেড়

কেজি অথবা ডাইকুয়াট আধ কেজি ৫০০ লিটার জলে মিশিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া প্রতি হেক্টরে দুই কেজি ২.৪ ডি সোডিয়াম লবণ অথবা এমসিপিএ ৪০০ লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করেও পার্থেনিয়াম দমন সম্ভব।

আগাছা পুড়িয়ে ফেলেও নষ্ট করা যেতে পারে। গাছগুলিকে কেটে গভীর গর্তে পুঁতে ফেলা যেতে পারে। কীটনাশক ব্যবহার করেও পার্থেনিয়াম ধ্বংস করা যেতে পারে। যদি চারা অবস্থায় গাছগুলিকে উপড়ে ফেলা যায় তাহলে বীজ ছড়ানোর সুযোগ পায় না গাছ। নানা ধরনের পাতাখেকো বা ঘাসখেকো পোকার মাধ্যমে পার্থেনিয়াম গাছকে দমন করা সম্ভব বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

পার্থেনিয়াম দমনের সময়ে কিছু সাবধানতা নেওয়া দরকার। পার্থেনিয়াম গাছে কোনও ভাবেই হাত দেওয়া উচিত নয়। বাচ্চাদের এই গাছ থেকে দূরে রাখা প্রয়োজন। পার্থেনিয়াম সাফাই অভিযানে অবশ্যই মুখোশ ও দস্তানা পরা জরুরি। এ ছাড়া ফুলহাতা জামা ও ফুলপ্যান্ট পরে সাফাই করা ভাল। গাছগুলি উপড়ে ফেলে কিছুদিন ফেলে রাখতে হয়। তারপর সেগুলি শুকনো হয়ে গেলে পুড়িয়ে ফেলা দরকার। পোড়ানোর সময় রেণু ছিটকে যাতে না আসতে পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। সাফাইয়ের পর জামাকাপড় ভাল করে ধুয়ে ফেলতে হবে। সাফাই অভিযানের পরে স্নান করে বাড়িতে ঢোকা দরকার।

পার্থেনিয়ামের একাধিক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তবে সম্প্রতি একটি গবেষণায় পার্থেনিয়ামের একটি ভাল দিক আবিষ্কার করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। পার্থেনিয়ামের ফুল ফোটার আগে গাছগুলিকে খুব সাবধানে কেটে নিয়ে গোবরের মধ্যে বেশ কিছুদিন ডুবিয়ে রেখে পচিয়ে নিলে গোবর সারের মধ্যে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেড়ে যায়। যা ফসল উৎপাদনের পক্ষে খুবই সহায়ক। এই প্রসঙ্গে ভারত সরকারের জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনের জাতীয় পরামর্শদাতা কৃষিবিজ্ঞানী কাঞ্চনকুমার ভৌমিক বলেন, ‘‘পার্থেনিয়াম একটি বিষাক্ত আগাছা। এর গাছ ফোটার সঙ্গেই নষ্ট করে ফেললে এর ক্ষতিকর প্রভাব খুব বেশি ছড়াতে পারে না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Parthenium Tree Nitrogen Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy