জুনেইদ হাফিজ। ছবি: টুইটার থেকে সংগৃহীত।
ধর্মদ্রোহের মামলায় দোষী সাব্যস্ত অধ্যাপককে মৃত্যুদণ্ডের সাজা শুনাইয়াছে পাকিস্তানি আদালত। ছয় বৎসর পূর্বে সমাজমাধ্যমে ধর্মীয় অবমাননাকর মন্তব্য লিখিবার পর হইতেই কট্টরপন্থীদের চক্ষুশূল ছিলেন জুনেইদ হাফিজ, পরে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ হন। এই কয় বৎসর ধরিয়া মকদ্দমা চলিয়াছে, আদালত সাক্ষী থাকিয়াছে প্রভূত উত্থানপতনের। বহু বিচারক বদলি হইয়াছেন, হাফিজের এক আইনজীবী খুন হইয়াছেন, বর্তমান আইনজীবীও নিরাপত্তা লইয়া সাতিশয় উদ্বিগ্ন। কারাগার-অভ্যন্তরে অভিযুক্তকে রাখা হইয়াছে অন্য বন্দিদিগের হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নিশ্ছিদ্র প্রহরায়, পাছে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হইবার পূর্বেই অন্য কাহারও হাতে প্রাণ চলিয়া যায়। মানবাধিকার, মত প্রকাশের অধিকারের ন্যায় ধারণাগুলিকে পাকিস্তান দণ্ডবিধির ধর্মদ্রোহ সংক্রান্ত ধারাটি যে বিন্দুমাত্র রেয়াত করে না, তাহাই প্রমাণিত হইতে চলিতেছে।
প্রতিবেশী দেশ সংবিধান হইতে আরম্ভ করিয়া দণ্ডবিধি কী রকম করিয়া সাজাইবে, তাহা তাহাদের নিজস্ব ব্যাপার। তবে উল্লেখ্য— মানবাধিকার ও মুক্তচিন্তার চর্চাকারী কিছু মানুষ ও প্রতিষ্ঠান ব্যতীত জুনেইদের মৃত্যুদণ্ড লইয়া সাংবিধানিক ভাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতে তেমন কথাও উঠে নাই। যে ধর্মটি পাকিস্তানে সরকার-স্বীকৃত ধর্ম, যে ধর্মের বিপ্রতীপে মন্তব্য করিয়া জুনেইদ প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত, তাহাকেই কাঠগড়ায় তুলিতেছেন অনেকে। অথচ নিজ দেশদর্পণে তাকাইলে দেখিতে পাইতেন, এই দেশেও রাষ্ট্রযন্ত্রের চালিকাশক্তি হইয়া উঠিতে চাহিয়া মাথাচাড়া দিতেছে ধর্ম। সংবিধানে ভারতকে যে সর্বৈব রূপে সার্বভৌম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করিয়া তুলিবার প্রস্তাবনা বিরাজমান, তাহা আজিকার ভারতে বিপন্ন। সংখ্যাগুরুর ধর্মে রাষ্ট্রের নাগরিকদের দীক্ষিত করিবার চেষ্টা, অন্য ধর্মাবলম্বীদের এবং নাস্তিকদের হেনস্থা করার চেষ্টা চলিতেছে। তথ্যে প্রকাশ, আফগানিস্তান বা ইরানের মতো পাকিস্তানে অদ্যাবধি ধর্মের অবমাননার অপরাধে কাহাকেও প্রাণদণ্ড দেওয়া না হইলেও বিগত তিন দশকে প্রাতিষ্ঠানিক বিচারব্যবস্থার বাহিরে অন্তত ৭৫টি হত্যার ঘটনা ঘটিয়াছে, তদ্বিষয়ক মামলার সংখ্যা দাঁড়াইয়াছে চার হাজারেরও অধিক। জন্মাবধি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উত্তরাধিকারী ভারত নিশ্চয়ই এই রূপ বাস্তব কল্পনা করিতেও শিহরিয়া উঠিবে।
মুক্ত স্বর গণতন্ত্রের অন্যতম পূর্বশর্ত। বিরোধী হউক ক্ষতি নাই, সামূহিক জীবনে হিংসাকে আকর্ষণ না করিলে তাহা বরং গণতান্ত্রিক সংলাপ ও যুক্তি-প্রতিযুক্তির আবহাওয়াকে ত্বরান্বিত করে। আজিকার ভারতের রাষ্ট্রনেতা হইতে জনগণ সবাইকে বুঝিতে হইবে, পাকিস্তানের বিপরীতে, ১৯৪৭ সালে নূতন ও স্বাধীন ভারত গঠনের ক্ষেত্রে উদারতার নীতিই ছিল প্রধান। এই দেশে বিজ্ঞানের গুরুত্ব ছিল, উন্নয়নের সাধনা ছিল। মুক্ত বহুস্বরের ঐতিহ্য এইখানে সুপ্রাচীন, সুদূর অতীতে বিস্তৃত। সেই ভারতও এ-ক্ষণে দেখিতেছে, সমাজমাধ্যমে কেহ সংখ্যাগুরুর ধর্মের জয়গান না করিলে প্লাবনের ন্যায় আছড়াইয়া পড়িয়াছে জীবননাশের হুমকি, গৃহদ্বারে ধাইয়া আসিয়াছে ধর্মোন্মাদ দুর্বৃত্ত। রাষ্ট্র যখন ধর্মকে নিজ সিংহাসনে বসাইতে চায়, সেই পরিস্থিতি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। ভারত শিক্ষা লউক, পাকিস্তান হইয়া উঠা কেন এবং কী রূপ বিপজ্জনক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy