Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
উন্নয়নের আবর্জনার চোটে ধ্বংসের মুখে হিমালয়ের বহু তীর্থ

ধর্মভ্রষ্টের তীর্থযাত্রা

এর মধ্যে যে একটা অন্যায় আছে, সেটা মনে মনে টের পাওয়া যায়। কিন্তু ঠিক কী অন্যায়? বলা যেতে পারে, অন্যের প্রতি অসংবেদী হতে নেই।

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

অরিন্দম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৯
Share: Save:

বছর চুয়াল্লিশ আগে হিমালয়ের কোলে যে গ্রামে লেখাপড়া জপধ্যান নিয়ে আমি ভিক্ষাজীবী সাধুর জীবন কাটাতাম, তার নাম মাতলি। জায়গাটা যেখানে এখন টিহরি বাঁধ হয়েছে, সেখান থেকে গঙ্গোত্রীর পথে উত্তরকাশীর ঠিক আগেই পড়ে। ভাগীরথীর তীরে ছোট্ট আশ্রম থেকে ওপরে মেঘমুলুকের মতো দেখায় যে গাড়োয়ালি গ্রামগুলি, তার বাসিন্দারা গরিব। পাহাড়ে ধাপ কেটে কষ্টসাধ্য চাষ, বন থেকে কুড়োনো কাঠে রান্না। তবু জায়গাটা যে দুর্গম, বেশি পর্যটক আসতে পারেন না, তাতে গ্রামের মানুষ খুশিই ছিলেন।

দশ বছর আগেও মাতলি যেতে হলে ট্রেন থেকে নেমেছি হরিদ্বারে। তার পরে হৃষীকেশ হয়ে নরেন্দ্রনগরে পাকদণ্ডী পথে গাড়িতে দু’দিকে পাইনের সারি-ঘেরা রাস্তা দিয়ে যাত্রা। এ বার রেলকে বাড়তি টাকা দিয়ে যাত্রার মেয়াদ বাড়ালাম দেহরাদূন অবধি। কারণ ট্রেন থেকেই দেখেছি, গেরুয়া গেঞ্জি-প্যান্ট পরে অজস্র লোক চলেছেন হরিদ্বার থেকে হিমালয়ের পথে। তাঁদের মোটর বাইকে, গাড়িতে পতাকা। যেমন আগেকার শ্রাবণের শিবব্রতীদের থাকত, সে রকম ‘নমঃ শিবায়’ পতাকা নয়, ভারতের জাতীয় পতাকা। ভিতর থেকে আসছে উৎকট ফিল্মি গান। মনে পড়ল, চার দশক আগে মাতলি গ্রামে কারও বিয়ে হলে গৃহকর্তা আগাম ক্ষমা চেয়ে যেতেন, ‘মেয়েরা গান গাইবে, একটু শব্দ হবে।’ উত্তরাখণ্ডের মানুষ চিরকাল জেনে এসেছেন, শব্দ মানে গঙ্গার শব্দ। সেই ‘হর হর’ শব্দে জগদীশচন্দ্র ভাগীরথীর উৎসকথা শুনতে পেয়েছিলেন।

বহিরাগতদের উপদ্রবে বিশ্বের সব দর্শনীয় স্থানের আদি বাসিন্দারা বিরক্ত। অক্সফোর্ডে বলা হয় ‘টাউন’ আর ‘গাউন’, অর্থাৎ শহরবাসীর সঙ্গে ছাত্রদের সংঘাত। কিন্তু হিমালয়ের শহরগুলিতে যাঁরা চলেছেন গাড়ির জানালা দিয়ে যথেচ্ছ প্লাস্টিকের ঠোঙা আর জলের খালি বোতল ফেলতে ফেলতে, তাঁরা তো কেবল পর্যটক নন। তাঁরা মনে করেন, তাঁরা ‘তীর্থযাত্রী’। টিহরি গাড়োয়ালের মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই অতিথিপরায়ণ। কিন্তু এই আধা-রাজনৈতিক উদ্ধত ধর্মধ্বজীদের সঙ্গে এই সংঘাত আরও গভীর। ‘তীর্থ’ মানে হল ঘাট। নদী বা পুকুরের বাঁধানো ঘাটই হল তীর্থ। তাই ঘাটহীন পুকুরকে বলা হয় ‘অকৃততীর্থ’। ভারতে সব দর্শনীয় ধর্মস্থান জলের ধারে, তাই তারা তীর্থ। তবে বহু যুগ ধরে ‘তীর্থভ্রমণ’ কথাটার অর্থে সঞ্চিত হয়েছে দু’টি ধারণা, পুণ্য আর ভ্রমণ। তীর্থস্থানের সঙ্গে থাকবে কোনও একটা গল্প, পুরাণ থেকে পাওয়া। যেমন কাশীখণ্ড, রেবাখণ্ড। গল্পের কেন্দ্রে থাকে কোনও অসামান্য ত্যাগ, কৃচ্ছ্রতাসাধন, লোকহিতৈষণার কথা। পুণ্যার্থী তীর্থে এসে সেই ভাব বা ‘স্পিরিট’ চিন্তা করেন, অনুভব করেন নিজের মনে।

ভ্রমণের গুরুত্বও কম নয়। পরিচিত বলয় থেকে বেরিয়ে নতুন দেশ, বিচিত্র মানুষ, রীতিনীতি দেখা। আমার গুরুদেবকে দেখেছি, নব্বই বছর বয়সে তীর্থে গিয়ে থেকেছেন দাক্ষিণাত্যে। কন্যাকুমারিকা মন্দিরে যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে বসা দোকানির থেকে রোজ একটা খেলনা কিনছেন। মাঝরাতে উঠে শিখছেন তামিল, মালয়ালি বর্ণমালা। যেখানে যাব, তাকে বুঝব-জানব, এই হল ভ্রমণের সারকথা। আধুনিক ভারতীয় ভ্রমণকারীর অন্য প্রদেশের জীবনধারার প্রতি প্রায়ই কোনও শ্রদ্ধা থাকে না। বাঙালির তো কৈলাস বা কন্যাকুমারিকা গেলেও মাছভাতের হোটেল চাই। অনভ্যস্ত খাদ্যে অস্বস্তি হয় ঠিকই। তবু স্থানীয়তা অধিক সম্মানের যোগ্য।

আজ তীর্থযাত্রী যেন শামুক। ঘরটাকে নিজের সঙ্গে টেনে চলেছেন। গাড়ির অভ্যন্তর, হোটেলের ঘর তৈরি রাখছে তাঁর অভ্যস্ত আরাম। ঠান্ডায় গিজ়ারের জল চাই, গরমে এসি। সাধুসন্ন্যাসীরাও সাধনকুটিরে ‘অ্যাটাচড বাথরুম’ চান। গ্রামের মানুষের জন্য শৌচ-নিকাশির ব্যবস্থা কী, জানতেও চান না। স্থানীয় জলবায়ু, আচার-আচরণ বাঁচিয়ে ক’টা দিন কাটান পর্যটকেরা। ফিরে এসে নালিশ করেন, ‘এখনও তেমন ফেসিলিটি নেই।’

উন্নয়ন মানে দাঁড়িয়েছে ‘ফেসিলিটি’ তৈরি করা। সরু, আঁকাবাঁকা পথ উধাও, পাহাড়ের গায়ে মস্ত চওড়া রাস্তা। মাতলি গ্রামের পথে নদীর ধারে ঢালু ছাদের টালির বাড়ি আর নেই, অজস্র পাকা বাড়ি উঠছে, সব ‘বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্ট’। দিল্লি, বারাণসী থেকে এসে যাঁরা এগুলো খুলছেন, তাঁরা কাজ দিচ্ছেন স্থানীয়দেরকে। বোঝাচ্ছেন, যত লোক আসবেন তত রোজগার বাড়বে। বাণিজ্য, প্রযুক্তি— এই দুটোই আসে ‘বিশ্বায়ন’-এর ধারণার আসঙ্গে। যা বলে সীমান্তহীন এক দুনিয়ার কথা। যে যেখানেই থাকো, বিশ্বসাথে যোগ থাকবে জ্ঞান-জীবিকা-সংস্কৃতিতে। কিন্তু পাহাড়ি তীর্থে দাঁড়ালে বোঝা যায়, বাণিজ্য-প্রযুক্তি বৈচিত্রের মধ্যে সংযোগ আনছে না। সবার বিশিষ্টতা নস্যাৎ করে একটিই ছাঁচে সবাইকে ফেলতে চাইছে। এই সঙ্কীর্ণতার সঙ্গে আবার জাতীয়তা যুক্ত হচ্ছে, যেন গোদের ওপর বিষফোড়া। টুরিস্ট আকর্ষণ হিসেবে গঙ্গারতি কোনও কালে উত্তরাখণ্ডের ট্র্যাডিশন ছিল না। কেবল বারাণসীতে অল্প কাল আগে শুরু হয়েছিল। এখন সন্ধ্যা হলেই কোনও একটা জলের ধার খুঁজে শুরু হয় গান আর প্রদীপের ঘূর্ণিপাক। সব স্থানের মাহাত্ম্য প্রকাশে একটিই উপায়, এটা তীর্থের ধারণাকেই নষ্ট করে।

কেবল ধারণাই তো নয়, ধ্বংসের মুখে হিমালয়ের অগণিত তীর্থ। প্লাস্টিক দূষণ থেকে কংক্রিট নির্মাণ, কিছুই স্থানীয় পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্রের অনুকূল নয়। হিমবাহ গলছে। এমন চললে হিমালয়-বেষ্টিত ভারতের ভূসম্পদ, জলসম্পদ, জৈবসম্পদ, ভাবসম্পদ থাকবে না। এ কথা লোকে জানেন, কিন্তু কেউ তাতে বিচলিত নন। তীর্থযাত্রীর যেমন স্থানিক বিচ্ছিন্নতা, এ তার অন্য পিঠ— কাল থেকে বিচ্ছিন্নতা। পর্যটক যেমন ভাবেন, ‘এই গ্রামের লোক তো আমার কেউ নন, আমার আরাম-আমোদের ব্যবস্থা করতে গিয়ে এঁদের ক্ষতি হলে আমার কী?’ তেমনই আমরা ভাবছি, ‘পঞ্চাশ বছর পরে যারা থাকবে, তারা খরায় পুড়বে নাকি বন্যায় ভাসবে, তাতে আমার কী?’

এর মধ্যে যে একটা অন্যায় আছে, সেটা মনে মনে টের পাওয়া যায়। কিন্তু ঠিক কী অন্যায়? বলা যেতে পারে, অন্যের প্রতি অসংবেদী হতে নেই। জিশু বলেছেন, প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালবাসবে। কিন্তু সে একটা অনুজ্ঞা, কেউ না মানতেই পারেন। অনেকে যুক্তি দেন, অন্যকে ‘নিজের মতো’ ভালবাসা অসম্ভব। ইংরেজ দার্শনিক টমাস হবস্ মনে করতেন, স্বার্থপরতা মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম। এমন নানা তত্ত্ব আছে যা ‘সাইকোলজিক্যাল ইগোইজ়ম’ প্রতিষ্ঠা করে।

বৌদ্ধরা বলবেন, ‘নিজেকে’ ভালবাসাই বা কী করে সম্ভব? চাকরি পেয়েই যুবক টাকা জমাতে শুরু করেছেন যার জন্য, সেই বৃদ্ধের সঙ্গে তার মিল কোথায়? অনাগত কালের সেই প্রবীণ ‘আমি’ তো এখন আদৌ নেই। সেই অলীক বুড়োটা কি এই তরুণের কাছে ‘পর’ নয়? তবু তার জন্যই সে আজকের ফুর্তির রসদ ত্যাগ করছে। নিরবচ্ছিন্ন ‘আমি’ বলে কিছু যখন নেই, তা হলে নিজের জন্য করা মানেই অপরের জন্য করা। অতএব পরার্থে কাজ মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম।

অপরের জন্য কেন করব, তার অন্য একটি সূত্র মেলে ঈশোপনিষদে। প্রথম শ্লোকে বলা হচ্ছে, ‘মা গৃধ কস্যস্বিদ ধনম্।’ সাধারণত এর ব্যাখ্যা হয়, কারও ধনে লোভ কোরো না। কিন্তু এ ভাবেও ভাবা যায়, ‘লোভ কোরো না। ধন কার?’ এমন কোনও সম্পদ নেই যাকে ‘আমার’ বলে দাবি করা যায়। যদি আমি চাষ করে ফসল ফলিয়ে থাকি, তা হলেও তার সম্পূর্ণ স্বত্ব আমার নয়। কারণ ওই জমি, ওই বীজ আমি তৈরি করিনি। করেছে প্রকৃতি। আর পূর্বপুরুষেরা। তাঁরা কৃষিজমি, বীজ, জল সুরক্ষিত রেখেছিলেন বলেই আমি ফসল পেয়েছি।

ইংরেজ দার্শনিক জন লক বলেছিলেন, আমার পরিশ্রম দিয়ে যা উৎপাদন করি, তা আমার সম্পত্তি। কিন্তু শ্রম তো করি শরীর দিয়ে। শরীর কি আমার সৃষ্টি, না কি পূর্বজদের? কেউ বলতে পারেন, ‘অত বুঝি না, জমির দলিল আমার নামে তাই জমি আমার।’ তা হলেও তাঁকে মানতে হবে, তাঁর মালিকানা অপরের উপর নির্ভরশীল, কারণ আইন তৈরি করে গিয়েছেন অন্যেরা। স্বত্ব-স্বামিত্ব নিয়ে যে ভাবেই চিন্তা করা যাক, তা থেকে অন্যদের দাবি বাদ দেওয়া যায় না। তাই বুঝতে হবে, যাকে নিজস্বত্ব বলা হয়, তা আসলে ব্যবহারের জন্য অপরের অনুমতি। ‘এই কৃষিজমি আমার’ বলার মানে এই নয় যে, ‘এই জমি আর কারও নয়।’ তার মানে, ‘এই জমি যাতে চাষযোগ্য থাকে, তার জন্য আমি বর্তমান প্রতিবেশী এবং আগামী প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধ।’ আমি যত বড় নিরঙ্কুশ ক্ষমতাশালী ধনকুবের হই না কেন, পৃথিবীর যে অংশটা আমি ‘আমার’ বলে দাবি করছি, সেটাও আমি ধার নিয়েছি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের জনসাধারণের কাছ থেকে।

দায় কার কাছে? পূর্বপুরুষদের কাছে, প্রতিবেশীর কাছে, আবার উদ্ভিদ, কেঁচো, জলজ প্রাণী থেকে শুরু করে সমগ্র জীবজগতের কাছে। তাই গৃহপ্রবেশের মন্ত্রে গৃহকর্তাকে আগে ওই বাস্তুতে বাসরত সব প্রাণীর অনুমতি নিতে বলা হয়। আহারের মন্ত্রে বলা হচ্ছে, আগে সাতটি ভাগে কেঁচো প্রভৃতি নানা প্রাণীর জন্য আহার্যের একটু অংশ সরিয়ে রাখতে হবে। বেঁচে থাকতে হলে অপরের থেকে গ্রহণ শেষ হওয়ার নয়, তাই ঋণ শোধ সম্ভব নয়। মানুষ মাত্রই চিরঋণী। এই ঋণ স্বীকার করাই ধর্ম, অস্বীকার অধর্ম।

কিন্তু অতীতের কাছে যে ঋণ, তা শোধ করব কী করে? তাঁরা নেই, তাঁদের ঋণ শোধ করতে হবে উত্তরকালের কাছে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রেখে যাওয়া সেই ঋণস্বীকার। আমার যা প্রাপ্য, তার বেশি নেওয়ার অর্থ, ভবিষ্যতের যে প্রাপ্য, তার থেকে ছিনিয়ে দিচ্ছি। সেটা না করাটা মহানুভবতা নয়, ঋণখেলাপের অপরাধ থেকে নিজেকে বাঁচানো।

ভারততত্ত্ব, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি (স্টোনি ব্রুক)

অন্য বিষয়গুলি:

Mountains Buddhism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy