প্রশ্ন: এ বছর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিভিন্ন মন্ত্রকের কাছে যা কিছু তথ্য (data) আছে, তা একত্র করা হবে। তাতে সমীক্ষা-প্রাপ্ত তথ্য থাকবে, আধার নম্বর-সমেত নাগরিকের বিবিধ ব্যক্তিগত তথ্যও (আর্থিক লেনদেন, সম্পত্তির মালিকানা, করদান, অপরাধ) থাকবে। সব তথ্যের সংযুক্তিকরণ হবে। তেমন তথ্য সকলের কাছে প্রকাশ করলে তা হয়ে উঠবে ‘সর্বজনীন বস্তুসম্ভার’ (public good)। একে কি স্বাগত জানাবেন?
প্রণব বর্ধন: স্বাগত জানাতে পারছি না। তথ্যকে ‘সর্বজনীন বস্তু’ বলার মানে কী, তার ধারণাটা এ ক্ষেত্রে গুলিয়ে গিয়েছে। ‘পাবলিক গুড’ অর্থনীতিতে একটি পরিভাষা। তার একটা অর্থ, এই বস্তুটি থেকে কোনও নাগরিক বাদ পড়বে না। যেমন সীমান্তে প্রতিরক্ষা। তার সুবিধে সব দেশবাসীই পাচ্ছে। আর একটি অর্থ, এক জন ব্যবহার করলে অন্যের কম পড়বে না। যেমন রাস্তা কিংবা পার্ক। তবে এ বছরের গোড়ায় আমরা একশো আট জন অর্থনীতিবিদ যখন সরকারকে চিঠি লিখে দাবি করেছিলাম যে তথ্য ‘সর্বজনীন বস্তু’, তখন তার আরও একটা বিশেষ প্রাসঙ্গিক যুক্তি ছিল। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এনএসএসও) প্রমুখ যে সরকারি সংস্থাগুলি তথ্য সংগ্রহ করে, তারা কাজ করে করদাতার টাকায়। অতএব সেই তথ্য সবার কাছে প্রকাশ করতে সরকার দায়বদ্ধ। এই কথাটা আমরা খোলা চিঠিতে লিখেছিলাম, কারণ নরেন্দ্র মোদী সরকার কর্মনিয়োগ-সংক্রান্ত রিপোর্ট চেপে রেখে দিচ্ছিল, প্রকাশ করছিল না, যাতে নির্বাচনের আগে দেশে বেকারের সংখ্যা ফাঁস না হয়ে যায়।
কিন্তু নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্যকে ‘সর্বজনীন বস্তু’ বলা যায় না। গোপনীয়তা বজায় রাখার আশ্বাস দিয়েও সরকার কোনও ব্যক্তির আর্থিক লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য কিংবা অপরাধ-সংক্রান্ত তথ্য ‘সর্বজনীন’ বা ‘পাবলিক’ বলে দাবি করতে পারে না। অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রণেতারা তথ্য-সম্পর্কিত অধ্যায়টির শিরোনাম দিয়েছেন, ‘মানুষের তথ্য, মানুষের দ্বারা, মানুষের জন্য’। আর্থিক লেনদেনের হিসেবের মতো ব্যক্তিগত তথ্য ‘মানুষের তথ্য’ ঠিকই, কিন্তু ‘মানুষের জন্য’ নয়। নাগরিকের সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য পরস্পর-সংযুক্ত করলে সরকারের সার্বিক নজরদারির একটা মস্ত সুযোগ তৈরি হয়। চিনে ইতিমধ্যেই তা দেখা যাচ্ছে। সেখানে ২০১৪ সাল থেকে ‘সোশ্যাল স্কোরিং’ শুরু হয়েছে। কেউ যদি ‘নন-স্মোকিং’ এলাকায় সিগারেট খায়, কিংবা ট্রাফিক আইন ভাঙে, তবে তার ‘সোশ্যাল স্কোর’ কমে যায়। স্কোর অনেকটা কমে গেলে নানা ‘শাস্তি’ মিলবে। যেমন, প্লেনের টিকিট কিনতে পারবে না, বা ট্রেনে বিশেষ কামরার টিকিট পাবে না। গণতান্ত্রিক দেশে এটা মানা যায় না। ভারতে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ব্যক্তিগত বিষয়ে নিভৃতির সুরক্ষা নাগরিকের মৌলিক অধিকার।
প্রশ্ন: কিন্তু অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রণেতারা দাবি করছেন, নানা ধরনের তথ্য সংযুক্ত করতে পারলে তবেই উন্নয়নের পরিকল্পনা ত্রুটিমুক্ত হবে, সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণে দুর্নীতি কমবে।
উ: ব্যক্তিগত তথ্য কোনও কারণেই সরকারের সম্পত্তি হতে পারে না, উন্নয়নকেও সেখানে অজুহাত করা চলে না। দুর্নীতি হল সরকারি সম্পদের বা ক্ষমতার অপব্যবহার, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত তথ্যের নিভৃতির (‘ডেটা প্রাইভেসি’) ব্যাপারটা গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়।
তবে সরকারের বিভিন্ন দফতরের কাছে যে সব তথ্য রয়েছে, সে সব একত্র করারই তো কথা। কিন্তু কে সেই তথ্যভাণ্ডারের দায়িত্বে থাকবে, তথ্য সংগ্রহ, যাচাই করা ও প্রকাশ করার দায়িত্ব কে পাবে, প্রশ্ন সেখানে। সরকার-সংগৃহীত সব তথ্য জমা পড়া উচিত এমন এক স্বশাসিত, স্বতন্ত্র সংস্থার কাছে, যার কাজে কোনও মন্ত্রী বা আধিকারিক হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এমন স্বাধীন সংস্থাই পারে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে, এবং উন্নয়নের প্রয়োজন বুঝে নানা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মিলিয়ে দেখে, বিচার-বিশ্লেষণ করে জনস্বার্থে তথ্যের যথাযথ ব্যবহার করতে। ব্রিটেনের ‘অফিস অব ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিকস’ তেমনই একটি সংস্থা। এটি সরকারি টাকায় কাজ করলেও কেবল মাত্র পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহি করে। ভারতেও এমন ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছিল, যখন ২০০১ সালে রঙ্গরাজন কমিটি জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন তৈরির সুপারিশ করেছিল। কথা ছিল, এই কমিশন কেবল সংসদের কাছে দায়বদ্ধ হবে। ২০০৬ সালে কমিশন তৈরি হল বটে, কিন্তু কাজের বেলা তাকে পুরোদস্তুর প্রয়োগ করার মতো কর্মী বা পরিকাঠামো দেওয়া হল না, কমিশনের স্বাতন্ত্র্যও রইল কেবল খাতায়-কলমে। কমিশন ‘পরিসংখ্যান এবং যোজনা রূপায়ণ’ মন্ত্রকের অধীন হয়ে রইল। আর এখন তো দেখছি, আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। এ বছর সরকারি নির্দেশে জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এনএসএসও) আর কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান সংস্থা (সিএসও), দু’টিকেই আনা হয়েছে পরিসংখ্যান মন্ত্রকের অধীনে। পরিসংখ্যান সচিবই দু’টি সংস্থার প্রধান।
প্রশ্ন: এতে সমস্যা কোথায়?
উ: সরকারি আধিকারিকদের উপরে পরিসংখ্যান সংগ্রহ ও প্রকাশের দায়িত্ব থাকার সমস্যা এই যে, মন্দ ফলগুলো তাঁরা চেপে যেতে চান। যে সব পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে যে প্রকল্প রূপায়ণে গাফিলতি রয়ে গিয়েছে, সেগুলো হয়তো সংগ্রহ করাই হল না। কিংবা সংগৃহীত হয়ে থাকলেও ব্যবহার করা হল না। অথবা হয়তো তথ্য-পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করার সময়ে বেছে বেছে এমন পদ্ধতি ব্যবহার করা হল, যাতে তার ফল খানিকটা ভাল দেখায়। প্রকাশিত রিপোর্ট পড়ে সব সময়ে বোঝাও যায় না, কোন তথ্যটা ব্যবহার হয়েছে আর কোনটা বাদ গিয়েছে।
যখন স্বাধীন কোনও মূল্যায়ন হচ্ছে, তখন বাস্তবের সঙ্গে সরকারি রিপোর্টের ফাঁকটা ধরা পড়ছে। যেমন, প্রশাসনের সংগৃহীত তথ্য অনুসারে গুজরাতের গ্রামাঞ্চল উন্মুক্ত স্থানে শৌচ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, কিন্তু কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা (সিএজি) তাদের নিজস্ব সমীক্ষায় পেয়েছে যে অন্তত ত্রিশ শতাংশ গ্রামে এখনও সেই কু-অভ্যাস রয়েছে। আসলে সরকারি প্রকল্পের ‘টার্গেট’ থাকে। লক্ষ্যপূরণ না করতে পারলে তা আধিকারিকদের ব্যর্থতা। তাই তাঁদের উপর তথ্য সংগ্রহ কিংবা প্রকাশের দায়িত্ব দিলে তাতে জল মেশার সম্ভাবনা থাকবেই।
সবচেয়ে বড় আশঙ্কা, তথ্য প্রকাশই না করা। কাজ ও নিয়োগ সংক্রান্ত রিপোর্ট নিয়ে শোরগোল হওয়ার পর সে রিপোর্ট বেরোল ছ’মাস দেরিতে, নির্বাচন শেষ হওয়ার পরে। কিন্তু কত চাষি আত্মহত্যা করেছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ২০১৬ সালের পর থেকে সেই তথ্য প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছে। গোরক্ষকরা কত মানুষকে হত্যা করছে, জেলবন্দি মানুষদের কত জন দলিত-মুসলিম, এমন তথ্য পাওয়া মুশকিল। তথ্য যখন সরকারের পক্ষে সুবিধাজনক তখন প্রকাশিত হবে, আর অস্বস্তিকর হলে হবে না, এ কেমন কথা? সমস্যা বেসরকারি সংস্থাকে নিয়েও। কর্পোরেট সংস্থাগুলির বার্ষিক আয়-ব্যয়ের তথ্য থেকে জাতীয় মোট উৎপাদনের (জিডিপি) হিসেব করা হয়। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাগুলো আইন অগ্রাহ্য করে। তথ্য গোপন করে, ব্যর্থতা ঢাকতে বেছে বেছে তথ্য পাঠায়। ফলে জিডিপি-র হিসেবে গোলমাল হচ্ছে।
উন্নয়নের পরিকল্পনার জন্য উপযুক্ত তথ্য পেতে হলে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনকে যথাযথ মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য দিতে হবে। তাকে যথেষ্ট রসদ দিতে হবে, তার পরিকাঠামোকে আরও মজবুত করতে হবে। বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সংরক্ষণ, তথ্য যাচাই করা, বিশ্লেষণ করা, নিয়মিত প্রকাশ করা, এ সবের দায়িত্ব জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনকেই দিতে হবে, কোনও মন্ত্রককে নয়।
প্রশ্ন: তা হলে তথ্যকে ‘সর্বজনীন বস্তু’ বললে আমরা কী বুঝব?
উ: বুঝব— সরকারি দফতর বা সংস্থার কাছে যে তথ্য রয়েছে, তা পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের রয়েছে। হয়তো দেশের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সামান্য কিছু তথ্য গোপনীয় হতে পারে। কিন্তু অর্থনৈতিক, সামাজিক তথ্য গোপন করার অধিকার সরকারের নেই। দ্বিতীয়ত, সেই তথ্যই ‘সম্পদ’ হতে পারে যা বাস্তবের যথাযথ প্রতিফলন। সমীক্ষা যেন কেবল নিয়মরক্ষা না হয়ে ওঠে। তার প্রশ্ন এমন ভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি নিখুঁত ভাবে ধরা পড়ে। এবং শেষ কথা, তথ্য হল সরকারের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার অস্ত্র। নাগরিক যাতে সরকারের কাজের বিচার করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তার হাতে তুলে দিতে হবে তথ্য। অপ্রকাশিত, অসম্পূর্ণ, ভ্রান্ত তথ্যকে ‘সর্বজনীন সম্পদ’ বললে নাগরিকের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। শাসকদের গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
সাক্ষাৎকার: স্বাতী ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy