রাজ্যের আনাচেকানাচে যে ভাবে বোমা-বন্দুকের খোঁজ মিলছে, তাকে বিলক্ষণ পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগমনী বলা যেতে পারে। ভোট মানেই পশ্চিমবঙ্গে বিপুল অস্ত্রের ঝনঝনানি, বিপুলতর হিংস্রতা। কেন এই রাজ্যের রাজনীতি এমন হিংসাত্মক হয়ে উঠল, সেই প্রশ্নের উত্তর বহুমাত্রিক। প্রথমত, বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে পশ্চিমবঙ্গের সমাজের প্রধানতম বিভাজিকাটির নাম রাজনীতি। জাতপাত, ধর্ম, সবই এই রাজ্যের সামাজিক সমীকরণে উপস্থিত, কিন্তু সেই পরিচিতিকেও ছাপিয়ে যায় রাজনৈতিক পরিচয়। ফলে, এই রাজ্যে হিংসাত্মক ঘটনাগুলি প্রায় কখনও রাজনীতি-বিবর্জিত নয়। সংবাদপত্রের পাতায় প্রায়ই এর উদাহরণ পাওয়া যায়, যেখানে নিতান্ত পারিবারিক কোন্দলের ঘটনাতেও ক্ষমতাসীন ও বিরোধী, উভয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী পরস্পরের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলে। অতএব, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গে হিংসার ঘটনা চরমে উঠবে, তা এক অর্থে অনিবার্য। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে স্থিতিজাড্যের মাত্রাও সর্বভারতীয় স্তরের তুলনায় কিঞ্চিৎ বেশি— রাজ্যের বিধানসভা যে দলের দখলে, একেবারে তৃণমূল স্তরের রাজনীতিতেও তার প্রভাব বিপুল। ফলে, রাজনৈতিক হিংসার ক্ষেত্রেও শাসক দলের ভূমিকাই বেশি। কিন্তু, যে অঞ্চলগুলিতে বিরোধী রাজনীতি তুলনায় শক্তিশালী, সে সব অঞ্চলে হিংসার সমীকরণটিও উল্টো। এর থেকে বোঝা সম্ভব যে, এই রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা কোনও একটি বিশেষ দলের অস্ত্র নয়, তা সর্বজনীন আয়ুধ। ইতিহাসও সেই সাক্ষ্যই দেবে। পূর্ববর্তী বাম জমানায় হিংস্রতার ঘটনাগুলিতে চালকের আসনে বাম দলগুলির ‘সম্পদ’দের ভূমিকা রাজ্য বিস্মৃত হয়নি। এখন তৃণমূল কংগ্রেসের ‘তাজা ছেলে’রা সেই হিংসার প্রধান কান্ডারি। দুর্ভাগ্য, শাসকের রং পাল্টালেও রাজনীতির চরিত্র পাল্টায় না।
দ্বিতীয় স্তরের কারণটি চরিত্রে রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক। শিল্পবঞ্চিত এই রাজ্যে কর্মসংস্থানের বৃহত্তম ক্ষেত্রটির নাম রাজনীতি। শাসক দলের সঙ্গে থাকলে যে তেমন রোজগারের বিবিধ পথ খুলে যায়— কখনও উন্নয়ন খাতে আসা অর্থ নয়ছয় করে, কখনও সাধারণ মানুষের ন্যায্য প্রাপ্যের টাকার থেকে বখরা আদায় করে, কখনও গরু-কয়লা-বালি-পাথর চোরাচালানের মাধ্যমে, কখনও আবার সিন্ডিকেটের পথে— এই কথাটি পশ্চিমবঙ্গে সর্বজনবিদিত। কিন্তু, এই অধিকার বজায় রাখার পূর্বশর্ত হল রাজনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখা। শুধু পুরসভা দখল করাই যথেষ্ট নয়, তার প্রতিটি ওয়ার্ড দখল করা প্রয়োজন। বেশির ভাগ পঞ্চায়েতে জিতলেই চলে না, সব পঞ্চায়েতে জয়ী হওয়া জরুরি। নয়তো, যে আসন হাতছাড়া হল, রোজগারের সেই ক্ষেত্রটিও একই সঙ্গে হাতছাড়া হয়। এবং, রোজগার বজায় রাখার তাগিদটি এতই গুরুতর যে, মানুষের সমর্থনের ভরসায় তাকে ছেড়ে রাখা যায় না। জেতার সহজতম পথ গায়ের জোর— অতএব, নির্বাচন এলেই পশ্চিমবঙ্গ রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
সমস্যার তৃতীয় স্তর হল দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ। অভিজ্ঞতা বলবে, পশ্চিমবঙ্গের সমগ্র ভূগোল এখন অজস্র ছোট ছোট অঞ্চলে বিভক্ত, যার অধিপতি শাসক দলের কোনও এক নেতা। তাঁর প্রভাব সেই অঞ্চলটুকুতে সীমাবদ্ধ, রোজগারের সুযোগও। ফলে, দলের শীর্ষনেতৃত্ব যদি হিংসার মাত্রা কমাতেও চায়, তাতে এই গোষ্ঠীপতিদের কোনও লাভ নেই, অতএব আগ্রহও নেই। তাঁদের স্বার্থ নিজেদের এলাকার উপর প্রশ্নাতীত দখল বজায় রাখার মধ্যে সীমিত। বিরোধী রাজনৈতিক দলই হোক, বা নিজের দলের ভিন্ন কোনও গোষ্ঠী, দখলের প্রশ্নে সবাই সমান শত্রু। ফলে, রাজনৈতিক হিংসা শুধুমাত্র বিরোধী দলের প্রতি নয়, দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও সমান বিপজ্জনক। অর্থনীতির এই সমীকরণের সমাধান না করতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক হিংসা থামানো কার্যত অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy