সাধু সাবধান! ছুঁচালো কানের ‘এলফ’, উদ্ভট চেহারার ‘গবলিন’, ‘হবগবলিন’ হইতে দানবিক চেহারার হরিদ্রাভ ‘ওর্ক’— সকল বিদেহীই দ্রুত পরপার হইতে আসিয়া এখন এই ধরাধামে পরিভ্রমণ করিতেছে। অক্টোবরের শেষে এই হ্যালোউইনের রাতে কালিঝুলি মাখা ভয়ঙ্কর মুখে কেহ কেহ বাড়িতেও চলিয়া আসিতে পারে। তখন শালগম, মড়ার খুলি আঁকা কেক, ক্যান্ডিতে যথোচিত আপ্যায়ন করিয়া তাহাদের তুষ্ট করিতে হইবে। উহাদের শান্তিকল্পে সদর দরজায় হালকা আলো-সহ লাউ বা কুমড়া রাখা বিধেয়। আজ রবিবার, ফলে গত কাল শনিবারের রাতেই উহারা ইহজগতে নামিয়া আসিয়াছে। ভয় নাই, উহারা এলাকার পরিচিত, ছদ্মবেশী কিশোর-কিশোরী। জে কে রোওলিং জানাইয়াছেন, পরিচিত ধরিত্রীর বাহিরে হগওয়ার্টস স্কুলে হ্যারি পটার, রন এবং হারমিয়োনরা এই ভাবেই উৎসবে মাতে। ঐতিহ্যটি দীর্ঘ কালের। রোওলিঙের ঢের আগে টোকিয়েন নামে শ্মশ্রুসমন্বিত এক লেখক সাক্ষ্য দিয়াছেন, মধ্য দুনিয়ায় ফ্রোডো ও বিলবোরা দুষ্ট গ্রিনস্কিন, ওর্কদের কবল হইতে পৃথিবীকে বাঁচাইবার জন্য আংটি উদ্ধার করে। কায়াহীনদের সহিত পৃথিবীর সংঘাত ও সমঝোতা কি আজকের কথা!
সপ্তাহটি সত্যই ভয়ঙ্কর। পরবর্তী রবিবারে পৌঁছাইবার আগে এই বৃহস্পতিবারই কালীপূজা, অমাবস্যার মহানিশা। আগের রাতে ভূত চতুর্দশী হইতেই ডাকিনী, যোগিনী, রক্তখেকো পিশাচ ও প্রেতরা নামিয়া আসিবে। শ্মশানে কোনও কোনও শব উঠিয়া বসিতেও পারে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কোনও অশরীরীই এই সপ্তাহটিতে মনুষ্যলোককে রেহাই দিবে না। করোনাকালে বলা নিষ্প্রয়োজন, মড়ক ও মহামারিতেই ভূতেদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বাংলার পরিচিত উপকথায় ভিন্দেশে চাকুরিরত এক ব্যক্তির কথা আছে। বাড়ি আসিবার পর স্ত্রী তাহাকে যত্নআত্তি করিল, লোকটি ভাতের পাতে লেবু চাহিল। আচমকা নিবু নিবু হারিকেনের আলোয় নজরে আসিল, তাহার স্ত্রী রান্নাঘরের জানলা হইতে হাত বাড়াইয়া দশ হাত দূরের গাছ হইতে লেবু ছিঁড়িতেছে। সে স্বাভাবিক মনুষ্য নহে। ভয়ে অজ্ঞান হইয়া গেল লোকটি। পর দিন সকালে এক শ্মশানে জ্ঞান ফিরিল, জানা গেল, কয়েক মাস পূর্বে কলেরা মহামারিতে গোটা গ্রামটি উজাড় হইয়া গিয়াছে, তাহার পরিবার আর বাঁচিয়া নাই। সহজ কথায়, ভূতেরা কেবল অনিষ্টকারী নহে, তাহাদেরও স্নেহ-মায়া-পাতিব্রত্য ইত্যাদি অনুভূতি রহিয়াছে। ভূশণ্ডির মাঠে শিবু, কারিয়া পিরেত ও নৃত্যকালীর সহিত যাঁহাদের সাক্ষাৎ হইয়াছে, তাঁহারা এই কথা জানেন। পরশুরামের আগে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ভোজনরসিক বাঙালি ভূতেদের চিনিতেন। পোড়ো বাড়িতে ‘লসুন হ্যায় মরিচ হ্যায় চ্যাং ব্যাং শুঁটকি হ্যায়’ বলিলে তাহারা কুঁজ সারাইয়া দিত। কিন্তু রসগোল্লা, কাঁচাগোল্লা বলিলেই সর্বনাশ! ভূতেরা ওই সব মিষ্টান্ন পছন্দ করে না, তাহারা আর একটি কুঁজ আনিয়া বেচারি লোকটির পৃষ্ঠদেশে লাগাইয়া দিবে।
ভূত এবং পিশাচ উভয়েই অতৃপ্ত আত্মা, উভয়েরই পরপারে দলভারী করিবার প্রবণতা আছে। কিন্তু দুই গোষ্ঠীর কর্মপদ্ধতি পৃথক। কাউন্ট ড্রাকুলা রক্তলোলুপ পিশাচ, যাহার গলায় দাঁত বসাইয়া রক্তপান করিবেন, সেও অনুরূপ আদল পাইবে। হেমেন্দ্রকুমার রায় তাঁহার ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’ গল্পে এই রকম এক বঙ্গীয় ড্রাকুলার পরিচয় রাখিয়া গিয়াছেন। কোন ভূত রাম নামে জব্দ হইবে, আর কে মন্ত্রপূত ক্রসচিহ্ন দেখিলে পলাইবে, তাহা সঠিক জানিতে পারাই ধর্ম। কারণ মানুষী ও ভূতপৃথিবীতে ঢের তফাত। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা নাই, ভূশণ্ডির মাঠে ব্রহ্মদৈত্য ও মামদোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। লিঙ্গবৈষম্যও নাই। পুরুষ ভূত ব্যতিরেকেই শাঁখচুন্নি ও পেতনিরা মানুষের পিছন পিছন আসিয়া খোনা গলায় মাছ চাহিতে পারে। পোড়ো বাড়ির অভাবে দেশ-বিদেশে সর্বত্র ভূতেরা আজকাল তাহাদের আবাস বদলাইতে বাধ্য হইয়াছে। হাল আমলের হিন্দি ও ইংরেজি সিনেমা জানাইয়াছে, তাহারা মুখ্যত শিশুদের ‘সফট টয়’কে আশ্রয় করে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোনকেও নিষ্কৃতি দেয় নাই। অনলাইন পরীক্ষা বলিয়াই নিধিরাম চুপিসারে মোবাইলে ঢুকিয়া পড়ে, করালী স্যর বুরুনকে আর অঙ্কে তেরো দিতে পারেন না। বাঙালি ভূতশিকারি বরদা পরপারে ইতিহাস ঘাঁটিয়া জানাইয়াছেন, হ্যালোউইনের রাতে যে গ্রিনস্কিন দানবরা পৃথিবীতে নামিয়া আসে, তাহাদেরই একটি প্রজাতির নাম ট্রোল। ভূতেদের বিশ্বজয় আজি সর্বতো ভাবে সম্পূর্ণ।
যৎকিঞ্চিৎ
১৫৫তম জন্মবার্ষিকীতে লন্ডনে নিবেদিতার মূর্তি বসছে। নিবেদিতা, অর্থাৎ মার্গারেট এলিজ়াবেথ নোবল আইরিশ দুহিতা। হোমরুল আন্দোলনের তেজ তাঁর রক্তে, তাঁর নিজের পরিবার ব্রিটিশবিরোধী সেই আন্দোলনে যুক্ত। আর অাজ প্রাক্তন সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্রে তাঁর এই স্বীকৃতি: উপনিবেশ হিপ হিপ হুরে! তবে এই স্বীকৃতি কিন্তু এল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মুকুটরত্ন উপনিবেশ ভারতে নিবেদিতার বিপুল অবদানের সুবাদেই। সকল উপনিবেশের সেরা সে যে— এই জন্মভূমি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy