ফাইল চিত্র।
আমপানে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরা টাকা পান নাই, নেতারা ত্রাণের টাকা চুরি করিয়াছেন— এমন অভিযোগ রাজ্য সরকারকে বিব্রত করিয়াছিল। এই দফায় মুখ্যমন্ত্রী দলের নেতাদের ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়ার বাহিরে রাখিয়াছেন; প্রশাসন এবং নাগরিকের মাঝে আর কেহ নাই। নাগরিক স্বয়ং ক্ষতিপূরণের জন্য আবেদন করিবেন, ব্লক স্তরের আধিকারিকরা তাহা পরীক্ষা করিবেন, এবং সরকার সরাসরি যোগ্য প্রাপকের ব্যাঙ্কে টাকা পৌঁছাইয়া দিবে। সিদ্ধান্তটি একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক। রাজনৈতিক দল শীর্ষ নেতাদের স্বচ্ছ ও তৎপর ভাবমূর্তি গড়িতে চাহে। প্রশাসন চাহে অপচয় এবং দীর্ঘসূত্রতা এড়াইতে। হয়তো বিতরণ পর্বের শেষে হিসাব মিলাইলে আমপান-ত্রাণের তুলনায় অধিক সাফল্যের সাক্ষ্য মিলিবে ইয়াসে। নেতারা দুর্নীতির সুযোগ না পাইলে নাগরিকও খুশি হইবেন। কিন্তু রাজ্য-রাজনীতির নিরিখে সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিকও বটে। ১৯৭৮ সালের প্রবল বন্যায় দুর্গতদের নিকট ত্রাণ ও অর্থ পৌঁছাইতে পঞ্চায়েত সদস্যরা প্রাণের ঝুঁকি লইয়া পরিশ্রম করিয়াছিলেন। সেই অভূতপূর্ব রাজনৈতিক উদ্যোগ পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতি রাজের ভিত্তি স্থাপন করে। ২০২১ সালে দুর্গতদের সহায়তার কাজ হইতে বাদ পড়িলেন পঞ্চায়েত নেতারা।
ইহা সম্ভব হইয়াছে অনেকটাই প্রযুক্তির উন্নতির ফলে। পূর্বে জনপ্রতিনিধির সাহায্যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলির সুবিধা সকলের নিকট পৌঁছাইতে পারিত। এক জন বিধায়কের পক্ষে তাঁহার এলাকার লক্ষাধিক মানুষের সহিত নিয়মিত সংযোগ সম্ভব নয় বলিয়া, রাজীব গাঁধী তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্ব কালে সংবিধান সংশোধন করিয়া পঞ্চায়েত নির্বাচন আবশ্যক করিয়াছিলেন। আজ ডিজিটাল প্রযুক্তি ছড়াইয়াছে, ব্যাঙ্কিং পরিষেবাও গ্রামীণ গৃহস্থের নিকট পৌঁছাইয়াছে। ফলে, রাজনীতি ও প্রশাসনের বিবিধ স্তরে অনাবশ্যক সময় নষ্ট না করিয়া, সরকারি প্রকল্পের অর্থ সরাসরি নাগরিকের নিকট পৌঁছাইবার প্রবণতা ক্রমশ বাড়িতেছে। কিন্তু এই ‘স্বচ্ছ’ ব্যবস্থার বিপরীতে কেবল দুর্নীতির পাঁক রহিয়াছে, এমন নহে। রহিয়াছে নেটসংযোগহীনতার পরিখা; এবং চিরাচরিত বঞ্চনার খাদ, যাহা নাগরিককে তাঁহার প্রাপ্য হইতে দূরে রাখে। প্রান্তিক মানুষের দাবি প্রশাসনকে জানাইতে, এবং সরকারি সুযোগ-সুবিধা তাঁহাদের কাছে পৌঁছাইবার কাজটিই পঞ্চায়েত সদস্যদের করিবার কথা। সম্বৎসর ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব সংবিধান পঞ্চায়েত সদস্যদেরই দিয়াছিল।
পঞ্চায়েতগুলি ক্রমে সরকারি প্রশাসনের গ্রামীণ দফতর হইয়া উঠিয়াছে; সদস্যদের ভাবমূর্তি ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি’ হইতে প্রথমে ‘দলীয় কর্মী’, অতঃপর ‘রাজনৈতিক প্রশ্রয়প্রাপ্ত দুর্বৃত্ত’ হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু দরিদ্রের কি প্রতিনিধির প্রয়োজন ফুরাইয়াছে? নাগরিকের চরম বিপর্যয়ের মোকাবিলায় যদি নির্বাচিত প্রতিনিধির স্থান না থাকে, তাহা হইলে জনজীবনে রাজনীতির ভূমিকা কী, নির্বাচনের গুরুত্বই বা কোথায়, তাহা পুনরায় ভাবিতে হইবে। প্রশাসনিক আধিকারিকরা ঊর্ধ্বতন কর্তাদের নিকট জবাবদিহি করিয়া থাকেন, গ্রামবাসীর প্রয়োজনের প্রতি তাঁহাদের মনোযোগী করিবার কথা ছিল জনপ্রতিনিধিদের। রাজনৈতিক দল তাঁহাদের উপর আস্থা হারাইয়াছে। এখন গ্রামবাসীরা প্রশাসনকে কতটা দায়বদ্ধ করিতে পারেন, তাহাই দেখিবার পালা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy