দুর্দশার সেই ছবি।
ইনদওরে গৃহহীনদের সহিত যাহা ঘটিল, তাহা দেখিলে হীরক রাজার দেশে চলচ্চিত্রটির কিয়দংশ মনে পড়ে। হীরক রাজ্যে বর্ষপূর্তি উৎসব। রাজ্যের যাবতীয় মালিন্য মুছিতে উৎখাত হইতে হয় পথবাসীদের। শতচ্ছিন্ন তাঁবু, গৃহহীনদের চিৎকারের মধ্যে ধুলায় পড়িয়া থাকা ক্রন্দনরত শিশুর সেই ছবিটি আজও কী ভয়াবহ প্রাসঙ্গিক, ইনদওর তাহার প্রমাণ। সেখানে সরকারি উদ্যোগে ফুটপাতবাসী প্রবীণদের আবর্জনা ফেলিবার গাড়িতে তুলিয়া শহরের বাহিরে পাঠাইবার বন্দোবস্ত চলিতেছিল। কারণ? ইনদওর গত চার বৎসর দেশের পরিচ্ছন্নতম শহরের শিরোপা পাইয়াছে। অনুমান, সেই খেতাব অক্ষুণ্ণ রাখিতেই ‘আবর্জনা’ পরিষ্কারের এমন প্রবল আগ্রহ। স্থানীয়দের বাধায় অবশ্য সেই অভিযান সম্পূর্ণ হয় নাই। কিন্তু একটি জরুরি প্রশ্ন রাখিয়া গিয়াছে— শহরের মধ্যে যাঁহারা আশ্রয়হীন, নিঃস্ব, এবং প্রবীণ, এহেন নিষ্ঠুরতম ব্যবহারই কি তাঁহাদের নিয়তি?
প্রশ্নটি উঠিতেছে, কারণ ইনদওরের মতো প্রকাশ্যে না হইলেও প্রায় সমস্ত শহরেই ফুটপাতবাসীরা চরম উপেক্ষার শিকার। তাঁহারা সম্ভাব্য ভোটার নহেন। তাই রাজনৈতিক দলগুলির সুনজরও তাঁহাদের উপর পড়ে না। সুপ্রিম কোর্ট জীবনের অধিকার ব্যাখ্যায় প্রত্যেকের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করিবার উল্লেখ করিয়াছে। তৎসত্ত্বেও, ফুটপাতবাসীদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অধিকার যথাযথ সংরক্ষিত হইল কি না, তাহা লইয়া কেহ ভাবিত নহে। উপরন্তু, যখনই শহরের সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনা করা হয়, সর্বপ্রথম কোপটি পড়ে তাঁহাদের উপরে। পুনর্বাসনের বিষয়টিও বহু ক্ষেত্রে অবহেলিত থাকিয়া যায়। গৃহহীনকে যখন অস্থায়ী আশ্রয় হইতেও উৎখাত হইতে হয়, তখন তিনি যাইবেন কোথায়, বিশেষত যদি তিনি অশক্ত, প্রবীণ হন? ট্রাকে তুলিয়া পথপার্শ্বে নামাইয়া দিলে নূতন আশ্রয় খুঁজিবার, বা খাবার জোগাড় করিবার ক্ষমতাটুকুও তাঁহাদের নাই। নিরাশ্রয়, অবলম্বনহীন প্রবীণদের দায়িত্ব লইবার কথা রাষ্ট্রের এবং সমাজের। সেই দায়িত্ব এই দেশে তো যথাযথ পালন করা হয়ই না, উপরন্তু শহর হইতে মুছিয়া দিবার তোড়জোড় চলে। কোনও শাস্তিই সম্ভবত এই চরম অমানবিকতার উপযুক্ত নহে।
কোভিড-কালে এই পরিস্থিতি আরও শোচনীয় হইয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান বলিতেছে, ২০১৬ সালে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৮.৫ শতাংশ, এবং তাহা প্রতি বৎসর বৃদ্ধি পাইতেছে। অথচ, অতিমারি কালে বিদেশে সরকারি উদ্যোগে প্রবীণদের ‘ভাল’ রাখিবার জন্য যেরূপ নানাবিধ পরিকল্পনা লওয়া হইয়াছিল, ভারতে সেইরূপ সংগঠিত উদ্যোগ করা যায় নাই। ফুটপাতবাসী প্রবীণদের দুরবস্থা আরও বেশি। তাঁহারা কবে প্রতিষেধক পাইবেন, আদৌ পাইবেন কি না, কেহ জানে না। লকডাউনে কলিকাতায় আশ্রয়শিবির করিয়া গৃহহীনদের থাকিবার বন্দোবস্ত হইয়াছিল। কিন্তু কোভিড-বিধি যথাযথ পালন করা যায় নাই। চারতলা বাড়িতে ৪০০০ ফুটপাতবাসীর স্থান হইলে দূরত্ববিধি পালিত হইবে কী উপায়ে? প্রয়োজন ছিল, পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়া এই মানুষগুলির জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ করা, এবং সেই ব্যবস্থা যাহাতে অতিমারির সঙ্গেই ফুরাইয়া না যায়, তাহা নিশ্চিত করা। সেই সম্ভাবনা যে এখনও রাষ্ট্র বা নাগরিক সমাজের তরফে দেখা যাইতেছে না, ইহা অত্যন্ত লজ্জার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy