অর্থমন্ত্রী বলিয়াছিলেন যে, তিনি এমন বাজেট পেশ করিবেন, যাহা গত একশত বৎসরে কেহ দেখে নাই। ছাপানো পাতার পরিবর্তে তিনি ট্যাব দেখিয়া বাজেট পড়িবেন, এই কথাটি মাথায় রাখিয়া যদি নির্মলা সীতারামন এমন দাবি করিয়া থাকেন, তবে ভিন্ন কথা; নচেৎ, নরেন্দ্র মোদীর সরকার গত ছয় বৎসর যেমন বাজেট পেশ করিয়াছে, নির্মলা সীতারামন অবিকল তেমন আর একটি বাজেট শুনাইলেন। অর্থমন্ত্রী রাজকোষ ঘাটতি, ঋণের পরিমাণ ইত্যাদি গোপন করিবার চেষ্টা করেন নাই বটে, কিন্তু সেই স্বচ্ছতা উপরতলের মাত্র। পুরাতন প্রকল্পকে নূতন মোড়কে চালাইয়া দেওয়ার প্রবণতা, সেই আগামী পাঁচ-দশ বৎসরে বরাদ্দের হিসাবকে বর্তমান বাজেটের মধ্যে দেখাইয়া দেওয়া— সবই অপরিবর্তিত আছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে যে বরাদ্দ বৃদ্ধির হিসাব তিনি দিয়াছেন, তাহার একটি বড় অংশের টাকা খরচ হইবে কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধক প্রদানের কাজে; আরও বড় অংশের একটি টাকা খরচ হইবে ‘আগামী পাঁচ বৎসরে’। পরিকাঠামো ক্ষেত্রেও প্রকল্পগুলি অনেকাংশেই ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার পাইপলাইন-এর অন্তর্ভুক্ত। সেই বাবদ হাততালি পাও না হইলে সরকার তাহা আগেই পাইয়া গিয়াছে। প্রকল্পগুলি কী ভাবে প্রবর্তিত হইবে, তাহার মেয়াদ কী, এই প্রশ্নগুলির উত্তর এই বাজেটেও নাই। কৃষিতে তিনি কৃষকের পাওনাগন্ডা বৃদ্ধির হিসাব শুনাইয়াছেন— কিন্তু, কৃষি পরিকাঠামোয় যে সংস্কারগুলি অপরিহার্য, তাহার উল্লেখ করেন নাই। এমন বাজেটই এই জমানার অভিজ্ঞান। নির্মলা ট্র্যাডিশন বজায় রাখিয়াছেন।
অন্য দিকগুলিতেও তিনি ধারাবাহিকতা রক্ষা করিয়াছেন। তাঁহার এই বাজেটেও রাজস্ব প্রত্যাশার একটি বড় অংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণের মাধ্যমে উপার্জন। হাতে থাকা সম্পত্তি বেচিয়া ব্যয়নির্বাহ করা আদৌ ভবিষ্যৎমুখী আর্থিক নীতির অঙ্গ হইতে পারে কি না, সেই প্রশ্নটি যদি মুলতুবিও রাখা হয়, তবু প্রশ্ন— সরকার বেচিতে চাহিলেও কেহ কিনিতে চাহিবে কি? এয়ার ইন্ডিয়ার অভিজ্ঞতাটিকে মাথায় রাখিলে এই প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নহে। অন্য দিকে, ইন্দিরা-যুগের রাষ্ট্রবাদী বদ্ধ অর্থনীতির প্রতি এই সরকারের আকর্ষণটিও বাজেটে ফুটিয়া উঠিয়াছে। সোলার প্যানেল অথবা তুলা, বিভিন্ন গোত্রের পণ্যে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধি করিয়া তাঁহারা দেশি উৎপাদকদের উৎসাহ দেওয়ার কথা বলিতেছেন, কিন্তু প্রতিযোগিতায় নামিবার জন্য অর্থব্যবস্থায় প্রণোদনা সৃষ্টির কথা ভাবেন নাই। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থার জন্য যে অবকাশ তৈরি করা হইতেছে, তাহাও কতিপয় সরকার-ঘনিষ্ঠ সংস্থার জন্য কি না— সেই প্রশ্নও উঠিতেছে। নির্মলা তবে সাঙাততন্ত্রের ট্র্যাডিশনটিকেও রক্ষা করিলেন?
ভাষণে যাহা আছে, তাহা যদি সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে, যে কথাগুলি ভাষণে নাই, সেগুলিও ঐতিহ্যের অনুসারী। যেমন, অর্থমন্ত্রীর ভাষণে কর্মসংস্থান যোজনার উল্লেখ নাই। অতিমারি-আক্রান্ত অর্থব্যবস্থায় এই যোজনা বিপুল সংখ্যক মানুষের নিকট একমাত্র বিকল্প হইয়া উঠিবার পরও নাই; শুধু গ্রাম নহে, শহরের জন্যও এই ব্যবস্থা চালু করিবার দাবি জোরদার হওয়ার পরও নাই। প্রধানমন্ত্রী মোদী গোড়া হইতেই এই প্রকল্পটির বিরোধী, সেই কারণেই কি? বর্তমান অর্থবর্ষে খাদ্য সুরক্ষায় প্রকৃত বরাদ্দ বাড়িয়াছিল— এই বাজেটে কমিয়া গেল। দরিদ্র মানুষের হাতে নগদ টাকা পৌঁছাইয়া দেওয়ার কোনও পথের হদিসের কথা দূরে থাকুক, সরকার আদৌ সেই প্রয়োজন অনুভব করে কি না, অর্থমন্ত্রী তাহাও বলেন নাই। দেশে আর্থিক অসাম্য প্রবল হারে বাড়িতেছে— তাহার উল্লেখও বাজেটে নাই। এই অনুল্লেখগুলিও ধারাবাহিকতা বজায় রাখিয়াছে। নির্মলা সীতারামন মোদী সরকারের বাজেট পেশ করিয়াছেন— শতাব্দীর বাজেট নহে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy